দিল্লি, মুম্বই থেকে তো আছেই, এমনকী হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু থেকেও ইউরোপে যাওয়ার সরাসরি উড়ান রয়েছে। নেই শুধু কলকাতার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতই তা নিয়ে দরবার করুন না কেন, আপাতত সেই উড়ান চালু হওয়ার সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিয়েছে বিমান সংস্থাগুলি।
সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন দেশের বিমানমন্ত্রী গজপতি রাজু। কলকাতা থেকে ইউরোপের সরাসরি উড়ান চালু করার জন্য তাঁকেও অনুরোধ করেন মমতা। তিনি আশ্বাস দিয়ে যান, এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন।
কিন্তু কলকাতায় এসে এ বার এয়ার ইন্ডিয়ার কর্তা জানিয়ে দিলেন, সে সম্ভাবনা নেই। বিপুল লোকসান থেকে এখন সরকারি এই বিমান সংস্থা ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সংস্থার মুখপাত্র অনিল মেটার কথায়, ‘‘এমন রুটে এখন উড়ান চালানোর কথা ভাবাই হচ্ছে না, যা থেকে লোকসান হবে।’’
উদাহরণ দিয়ে মেটা জানান, অন্ডাল থেকে দিল্লিতে তাঁরা উড়ান চালাতে রাজি হয়েছেন শর্তসাপেক্ষে। টিকিট বিক্রি করে বিমান চালানোর ন্যূনতম খরচ বা অপারেটিং কস্ট না-উঠলে তাঁরা উড়ান চালাবেন না। অন্ডাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ভর্তুকি দিয়ে এখন উড়ান চালাচ্ছেন।
মেটা জানান, সমীক্ষা করে তাঁরা দেখেছেন, এখন কলকাতা থেকে ইউরোপের সরাসরি উড়ান চালালে তা থেকে অপারেটিং কস্ট উঠবে না। ফলে, সংস্থা কিছুতেই সেই উড়ান চালাবে না।
বছর কয়েক আগে কলকাতা থেকে ইউরোপে সরাসরি উড়ান চালাত এয়ার ইন্ডিয়া, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এবং লুফৎহানসা। সম্প্রতি কলকাতা বিমানবন্দরের অধিকর্তা অনিল শর্মা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও লুফৎহানসা-কেও চিঠি দিয়ে আবার উড়ান শুরু করার অনুরোধ করেছিলেন। লুফৎহানসা সেই চিঠির কোনও জবাবই দেয়নি। আর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, তারা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। তবে, তার আগে তারা ভাল ভাবে সমীক্ষা করে দেখতে চায়। কিন্তু সেই সমীক্ষা কবে হবে, তা জানা যায়নি।
এক বিদেশি বিমান সংস্থার কর্তার কথায়, ‘‘কেন কেউ কলকাতা থেকে ইউরোপে সরাসরি উড়ান চালাবে? এই শহর বা রাজ্যে সেই শিল্প বা বাণিজ্য কোথায় যে, উচ্চ শ্রেণির যাত্রীরা যাতায়াত করবেন?’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই শহরের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘‘দূরপাল্লার উড়ানে সাধারণ শ্রেণির যাত্রী পেলেও লাভের টাকা উঠবে না। বিজনেস ও প্রথম শ্রেণির যাত্রী চাই। কলকাতায় সেই যাত্রী সংখ্যা কোথায়?’’
প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কী করে কলকাতা থেকে দুবাই হয়ে ইউরোপ যাওয়ার জন্য নিয়মিত প্রথম শ্রেণির যাত্রী পাচ্ছে এমিরেটস?
ট্রাভেল এজেন্ট ফেডারেশনের পূর্বাঞ্চলের চেয়ারম্যান অনিল পঞ্জাবির কথায়, ‘‘এমিরেটস কলকাতার মাটি কামড়ে এত দিন পড়ে থেকে যাত্রীদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। তার পরে প্রথম শ্রেণির যাত্রী পেয়েছে।’’ কলকাতা থেকে দিনে দু’টি করে উড়ান চালাচ্ছে এমিরেটস। তাদের সকালের বিমানে প্রথম শ্রেণির আসন থাকলেও রাতের বিমানে নেই। ২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে রাতের বিমানেও প্রথম শ্রেণির আসন থাকবে। পঞ্জাবির কথায়, ‘‘ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, লুফৎহানসা, এয়ার ইন্ডিয়া প্রথম শ্রেণির যাত্রী পাওয়ার আশ্বাস পেলে তবেই আসবে বলেছে।’’ পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের যা ছবি, তাতে সেই আশ্বাস তাদের কেউ দিলেও তা তারা বিশ্বাস করবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এমিরেটস-এর মতো এ শহর থেকে ভাল ব্যবসা পাচ্ছে কাতারও। ২০১১ সালে কাতার কলকাতা থেকে উড়ান শুরু করেছিল ১৪৪ আসনের বিমান দিয়ে। সপ্তাহে সাত দিন প্রতিটি উড়ানেই গড়ে ৯০ শতাংশ যাত্রী হচ্ছিল। কলকাতা-দোহা রুটে ২ ডিসেম্বর থেকে ২৫৪ আসনের ড্রিমলাইনার ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছে তারা।
সংস্থার এক কর্তার কথায়, ‘‘কলকাতার যাত্রীদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ দোহা হয়ে আমেরিকা এবং প্রায় ৫৫ শতাংশ ইউরোপ যান। নিয়মিত এই যাত্রী সংখ্যা বাড়ছে।’’ এতিহাদ বিমান সংস্থা জানিয়েছে, তাদেরও কলকাতা থেকে আবু ধাবি হয়ে ইউরোপের যাত্রী বাড়ছে।
কলকাতা থেকে ইউরোপের সরাসরি উড়ান না-থাকার ফায়দা তুলছে পশ্চিম এশিয়ার এই তিনটি বিমান সংস্থা — এমিরেটস, কাতার এবং এতিহাদ। এখান থেকে ইউরোপ-আমেরিকা যেতে হলে এই মুহূর্তে যাত্রীদের এখন এই তিনটি সংস্থার উড়ানের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, এই তিন সংস্থা কী করে ব্যবসা পাচ্ছে?
সূত্রের খবর, পশ্চিম এশিয়ায় জ্বালানি তুলনায় সস্তা। এই মুহূর্তে বিমান সংস্থার সবচেয়ে বড় খরচ হয় এই জ্বালানি কিনতে গিয়েই। কলকাতা থেকে দুবাই, দোহা ও আবু ধাবি— এই তিন শহরের দূরত্ব বড়জোর চার-পাঁচ ঘণ্টার। ফলে, অপারেটিং কস্ট দূরপাল্লার উড়ানের চেয়ে কম। তিন জনেরই বিশাল নেটওয়ার্ক। দুবাই থেকে এখন বিশ্বের যে-কোনও প্রান্তে যাওয়া যাচ্ছে। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘পশ্চিম এশিয়ার এই তিন দেশের ভৌগোলিক অবস্থানও বড় কারণ। কলকাতা থেকে চার ঘণ্টার দূরত্বে দুবাই-দোহা-আবুধাবি পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ৬-৭ ঘণ্টা উড়ে আবার পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে ইউরোপ। অথচ কলকাতা থেকে সরাসরি ইউরোপের উড়ান চালু হলে একটানা ১০-১২ ঘণ্টা উড়তে হবে।’’