কলেজে পড়া শেষের আগেই ক্যাম্পাসিংয়ে মোটা মাইনের চাকরি। বিদেশে কাজের সুযোগ। এমনকী ‘বিয়ের বাজারে কুলীনের মর্যাদা’। কিছু দিন আগে পর্যন্তও ভাল চাকরির যাবতীয় হাতছানি তোলা থাকত তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের জন্য। সে ভাবে ‘কাজ খোঁজা’র প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু এক দিকে আমেরিকা-ব্রিটেনের ভিসা নিয়ে কড়াকড়ি। আর অন্য দিকে, মেশিনের কাজ কাড়া। এই দু’য়ের সাঁড়াশি আক্রমণে এখন সেই ছবি পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত। এবং তা একেবারে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট চাকরি খোঁজার ওয়েবসাইটগুলির (জব পোর্টাল) পরিসংখ্যানের দিকে এক ঝলক তাকালেই। দেখা যাচ্ছে, সম্পতি সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের সিভি (বায়োডেটা) জমা দিয়ে রাখার প্রবণতা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে কিছু দিন আগেও যা অভাবনীয় ছিল।
চলতি বছরের প্রথম ছ’মাসের পরিসংখ্যান বলছে, আগের তুলনায় অনেক বেশি চাকরির আবেদন জমা পড়ছে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে। যেমন, মনস্টারে তা বেড়েছে ৬০% থেকে ৬৫%। নকরি-তে ২৭%। আইআইএম জবস-এ ১২.৪%। কেরিয়ার বিল্ডারে ১১.৫%। প্রায় একই ধরনের ছবি চাকরি খোঁজার অন্যান্য প্রায় সমস্ত ওয়েবসাইটেই।
মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সবে শুরু। এর পরে বাজারে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের জোগান আরও বাড়বে। ফলে তখন ভাল চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে অ্যানালিটিক কনসাল্টন্ট্যাসের তুষার বসুর দাবি, এত দিন আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নজর দেয়নি সংস্থাগুলি। জোর দিয়েছে মূলত তুলনায় কম খরচে কর্মী সরবরাহের দিকে। ফলে একই জায়গায় আটকে থেকেছে কর্মীদের দক্ষতা। যন্ত্রের কারণে এখন সেই ঘাটতি বিপদঘন্টি বাজাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন:
৮ শতাংশ সুদে প্রবীণদের জন্য নয়া পেনশন প্রকল্প কেন্দ্রের
প্রায় একই সুরে উইজডমজবস-এর প্রধান অজয় কোল্লা জানান, অধিকাংশ সংস্থাই কর্মীদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত নয়। ফলে চাকরি চলে যাওয়ার এই হিড়িকে নতুন কাজ পাওয়া বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
যন্ত্র আর রোবটের কাছে মানুষ কাজ খোয়াতে শুরু করেছে আজ অনেক দিন। সহজেই তা টের পাওয়া যায় বড়-বড় কারখানায়। কিন্তু এখন কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তির দৌলতে তা ছিনিয়ে নিচ্ছে এমন অনেক কাজ, যা কিছু দিন আগেও ছিল কল্পনার বাইরে। তা সে কাজ ব্যাঙ্কের কর্মীর হোক বা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে যন্ত্রের কারণে ৬৯% চাকরি কমতে পারে ভারতে।
কাজ লোপাট
• ভারতে কাজের সুযোগ কমছে ৫ বছর ধরেই। হালে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৫৬ হাজার জন
• ২০১৫-’১৬ সালে নিয়োগের কথা ছিল ২.৭৫ লক্ষ। হয়েছে ২ লক্ষ
• কাজের সুযোগ তৈরির ছবি মলিন ২০১৬-’১৭ সালেও
• ২০২১ সালের মধ্যে কাজ কমবে ৬.৪ লক্ষ। লোপাট হতে পারে ৬৯% চাকরি
• ২০১৬ সালে ১২% লোক কম নিয়েছে টিসিএস, উইপ্রো, ইনফোসিস ও এইচসিএল
• ছাঁটাইয়ের খবর মিলেছে কগনিজ্যান্ট, আইবিএম, ইনফোসিস, টেক মহীন্দ্রা, ক্যাপজেমিনি-সহ প্রায় সমস্ত সংস্থায়
• গত বছর শুধু ইনফোসিসেই ১১ হাজার কর্মীর কাজ কেড়েছে মেশিন। একই ধরনের ছবি বাকি সংস্থাতেও
** তথ্যসূত্র: হর্সেস ফর সোর্সেস রিসার্চ ও বিশ্বব্যাঙ্ক
আন্তর্জাতিক সমীক্ষা সংস্থা হর্সেস ফর সোর্সেস রিসার্চের দাবি, চার বছরের মধ্যে ৬ লক্ষ ৪০ হাজার কাজের সুযোগ হারিয়ে যাবে এই দেশে। বিশেষত মার খাবে তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা ও বিপিও। যেখানে অনেক ক্ষেত্রে একই কাজ করতে হয় বারবার। কিছু কাজে দক্ষতাও লাগে তুলনায় সামান্য কম।
প্রযুক্তি-সুনামির এই ঢেউ যে ধীরে-ধীরে উঠতে শুরু করেছে, তা স্পষ্ট রাজ্যে ব্যবসা করা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির পরিসংখ্যানেই। টিসিএস, কগনিজন্যান্ট, উইপ্রো— স্বয়ংক্রিয় মেশিনের কারণে (অটোমেশন) কর্মী নিয়োগে রাশ টানছে তিন সংস্থাই। তা ছাড়া, এই শিল্পে কর্মীদের একটি বড় অংশই যেহেতু দক্ষিণ ভারতীয় ও বাঙালি, তাই কাজখেকো রোবটের বিপদঘণ্টি সজোরে বাজার আওয়াজ অবশ্যই শুনতে পাচ্ছেন তাঁরা।
শুধু চাকরি খোয়ানোই নয়। নতুন চাকরির সুযোগও কমছে দ্রুত। ন্যাসকমের হিসেব অনুযায়ী, গত বছর ১.৭ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে। চলতি বছর তা ১.৩ থেকে ১.৫ লক্ষের মধ্যেই আটকে থাকবে। সব মিলিয়ে কর্মসংস্থানে বৃদ্ধির হার চার শতাংশের আশপাশেই ঘোরাফেরা করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। উদাহরণ হিসেবে উঠে এসেছে ক্যাপজেমিনি, টিসিএস ও ইনফোসিসের কথা। গত বছর ক্যাপজেমিনি ৩৩,০০০ কর্মী নিয়েছে। এ বছর তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২০,০০০। গত বছরের তুলনায় ইনফোসিস ও টিসিএসের মতো সংস্থায় নিয়োগ সামান্যই বেড়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের পাশাপাশি উৎপাদন শিল্পেও কর্মসংস্থানের ফিকে ছবি উঠে এসেছে। বণিকসভা ফিকির সমীক্ষা বলছে, আগামী তিন মাসে নতুন কর্মসংস্থানের বিশেষ সুযোগ নেই উৎপাদন শিল্পে। ৩০০টি বড় সংস্থাকে নিয়ে করা এই সমীক্ষায় ৭৩% সংস্থা জানিয়েছে নতুন কর্মী নেওয়ার পরিকল্পনা আপাতত নেই। তার প্রধান কারণ উৎপাদন এখনই না-বাড়ানোর সিদ্ধান্ত। কাজ না-বাড়লে কাজের লোক নেবে না কোনও সংস্থাই।
সব মিলিয়ে, কর্মসংস্থানের ‘আচ্ছে দিন’ এখনও দূর অস্ত্।