পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আয়করে কোনও ছুট নেই—ফাইল চিত্র
ছোট থেকেই জানি, রাস্তায় পা না-রাখলে রোজগার নেই। অথচ এখন দেখছি বাইরে বার হলে অতিমারির কামড়ে জীবন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। ফলে দিন কে দিন জীবন কঠিন থেকে আরও কঠিন হচ্ছে। সে পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে আরও একটি বিষয়। তার নাম আয়কর। করোনা পরিস্থিতিতে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে একাধিক সুবিধা দিচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে আয়কর এবং তার রিটার্ন জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানোও। কমানো হয়েছে উৎসে কাটা করের হার। কিন্তু মাথায় রাখবেন, আয়করের দায় কিন্তু কমেনি। অর্থাৎ চারপাশে হরেক সমস্যা থাকলেও করের ব্যাপারটি ভুললে চলবে না। তাই এক বার হিসেব কষে নেব কোন খাতে কত কর গুনতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভকর
শেয়ার ও ইকুইটি ফান্ডে
২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের আগে শেয়ার ও ইকুইটি ফান্ডের লগ্নি দীর্ঘমেয়াদে (এক বছর বা তার বেশি) ধরে রাখার পরে বিক্রি করে কোনও মুনাফা হলে (দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভ) তা ছিল পুরোপুরি করমুক্ত। ২০১৮ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে এই লাভের উপরে কর বসানোর প্রস্তাব আনা হয়। পরে এই প্রস্তাব আইনে পরিণত হলে তা ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়। সেই অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষ থেকে শেয়ার এবং ইকুইটি ফান্ডে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভ হলে তার উপরে ১০% কর গুনতে হচ্ছে করদাতাকে। তবে বছরে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূলধনী লাভের উপর কোনও কর দিতে হবে না। এই লাভের হিসেব কী ভাবে কষা হবে তা-ও নতুন আইনে স্পষ্ট করা হয়েছে।
আগে দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট শেয়ার অথবা ইউনিট কিনতে কত খরচ হয়েছিল (কস্ট অব অ্যাকুইজ়িশন)। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট ফর্মুলা দেওয়া হয়েছে নতুন আইনে।
১) সংশ্লিষ্ট শেয়ার বা ফান্ডের ইউনিট কেনার প্রকৃত খরচ।
২) ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ওই শেয়ার বা ইউনিটের উচিত মূল্য (ফেয়ার প্রাইস)। অর্থাৎ, ওই দিন শেয়ারটির সর্বাধিক বাজার দর অথবা ফান্ড ওই ইউনিটের ন্যাভ।
এই দুয়ের মধ্যে যেটি বেশি তাকেই শেয়ার বা ফান্ডের খরচ ধরে বিক্রয় মূল্য থেকে বাদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভের হিসেব কষতে হবে। সারা বছরে এই ধরনের মোট মুনাফার প্রথম ১ লক্ষ টাকা থাকবে করমুক্ত। এর অতিরিক্ত লাভের উপরে কর দিতে হবে ১০% হারে।
কয়েকটি উদাহরণ দিলে হিসেবটি বুঝতে সুবিধা হবে:
• ধরা যাক ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি একটি শেয়ার কেনা হল ১০০ টাকা দামে। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ওই শেয়ারের সর্বোচ্চ বাজার দর ছিল ১৫০ টাকা। পরে ওই শেয়ার বিক্রি করা হল ২০০ টাকায়। এ ক্ষেত্রে মূলধনী লাভ হবে ৫০ টাকা (বিক্রয়মূল্য ২০০ টাকা, ক্রয়মূল্য ১৫০ টাকা)।
• ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি একটি শেয়ার কেনা হল ১০০ টাকায়। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ওই শেয়ারের উচিত মূল্য অর্থাৎ, সর্বাধিক দর ছিল ২০০ টাকা। পরে শেয়ারটি ১৫০ টাকায় বিক্রি করা হল। আদতে লাভ হলেও বিক্রি করে পাওয়া টাকা (১৫০ টাকা) উচিত মূল্যের (২০০ টাকা) চেয়ে কম হওয়ায় লাভের অঙ্ক শূন্য ধরা হবে। ফলে কোনও কর গুনতে হবে না।
• ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি একটি শেয়ার কেনা হল ১০০ টাকায়। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তার সর্বাধিক বাজার দর ছিল ৫০ টাকা। পরে ওই শেয়ার ১৫০ টাকায় বিক্রি করা হল। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্রয়মূল্যের (১০০ টাকা) চেয়ে উচিতমূল্য (৫০ টাকা) কম হওয়ায় প্রকৃত ক্রয়মূল্যকেই কস্ট অব অ্যাকুইজ়িশন হিসেবে ধরতে হবে। ফলে এ ক্ষেত্রে মূলধনী লাভ হবে ৫০ টাকা (১৫০ টাকা-১০০ টাকা)।
আর ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারির পরে কোনও শেয়ার বা ইকুইটি ইউনিট কিনলে তার প্রকৃত ক্রয়মূল্যই হবে কস্ট অব অ্যাকুইজ়িশন। এক বছর ধরে রাখার পরে বেচে কোনও লাভ হলে তার উপরে কর দিতে হবে ১০% হারে।
ডেট ফান্ডে
মূলত ঋণপত্র নির্ভর অর্থাৎ ডেট ফান্ডে কোনও লগ্নি তিন বছর বা তার বেশি সময় ধরে রাখার পরে বিক্রি করে লাভ হলে, সেই মুনাফা দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভ হিসেবে গণ্য হয়। সেই লাভের উপরে কর গুনতে হয় ২০% হারে। তবে এই লাভের হিসেব কষার সময়ে মূল্যবৃদ্ধি সূচক (কস্ট ইনফ্লেশন ইনডেক্স) প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে প্রকৃত লাভের অঙ্ক অনেকটাই কমে যায়। যার ফলে কম হয় করের দায়ও। ২০০০-২০০১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে প্রত্যক বছর অর্থ মন্ত্রক ক্রয়মূল্য বৃদ্ধি সূচক প্রকাশ করে।
উদাহরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি:
ধরা যাক, ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল একটি ডেট ফান্ডে ১০,০০০ টাকা লগ্নি করা হল। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তা বিক্রি করে ১৩,৫০০ টাকা পাওয়া গেল। আপাতদৃষ্টিতে লাভের অঙ্ক দাঁড়ায় ৩৫০০ টাকা। কিন্তু ক্রয়মূল্যের উপর ক্রয়মূল্য বৃদ্ধি সূচক প্রয়োগ করলে তা আরও বাড়বে। সে কারণে কমবে লাভের অঙ্ক, কর বাবদ দায়ও। ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে সূচক ছিল ২৬৪ যা ২০১৯-২০ সালে বেড়ে হয়েছে ২৮৯। এই হারে বৃদ্ধি যদি ক্রয়মূল্যের উপরে প্রয়োগ করা যায় তা হলে ক্রয়মূল্য বেড়ে দাঁড়াবে (১০,০০০x২৮৯)/২৬৪ টাকা। অর্থাৎ, ১০,৯৪৭ টাকা। সে ক্ষেত্রে দাম বাড়ায় লাভ কমে দাঁড়াবে ২৫৫৩ টাকা। এর উপরে ২০% হিসেব ৫১১ টাকা কর গুনতে হবে।
স্বল্পমেয়াদি মূলধনী লাভকর
ইকুইটি লগ্নিতে
এক বছরের কম সময় ধরে রাখার পরে কোনও শেয়ার অথবা ফান্ডের ইউনিট বিক্রি করে লাভ হলে তা স্বল্পমেয়াদি মূলধনী লাভ হিসেবে ধরা হবে। এই লাভের উপরে কর দিতে হয় ১৫% হারে।
ডেট ফান্ডে
লগ্নির দিন থেকে তিন বছরের আগেই কোনও ডেট ফান্ডের ইউনিট বিক্রি করে লাভ হলে তা স্বল্পমেয়াদি মূলধনী লাভ এবং তা লগ্নিকারীর অন্যান্য আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। তার উপরে প্রযোজ্য হারে গুনতে হবে আয়কর।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)