এখন ছায়া গার্মেন্টসের বেশ নামডাক হয়েছে। বছর পাঁচেক আগে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে এই জামাকাপড়ের দোকানটি খুলেছিলেন অমল। নাম দেন মায়ের নামে। জিনিসের মান নিয়ে কখনও কোনও আপস করেননি। ছেলেদের জামাকাপড়ের জন্য এলাকার প্রায় সকলে ওঁর দোকানেই আসেন। কিন্তু অমলের এখন চিন্তা, কী ভাবে ব্যবসাটা বাড়ানো যেতে পারে। তিনি ঠিক করেছেন, এ বার পুজোর আগেই দোকানটা আরও বড় করতে হবে। ছেলেদের পাশাপাশি এ বার মেয়েদের আর ছোটদের জন্যও আধুনিক ডিজ়াইনের জামাকাপড় রাখতে হবে। আপনিও কি অমলের মত নিজের ব্যবসা আরও বাড়ানোর কথা ভাবছেন? তা হলে আলোচনা করা যাক, ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে গেলে কোন কোন দিক দেখে নেওয়া উচিত, সে বিষয়ে।
কী করে বুঝবেন
ব্যবসা চালু করা এক জিনিস, আর তা সম্প্রসারণ আর এক। তাই ব্যবসা বাড়াব বলেই বাড়ানো নয়। জেনে নিতে হবে, কোন ব্যবসা বাড়ানো যাবে আর কোনটা যাবে না। কখনই বা ব্যবসা বাড়ানোর সময়। সেটা বুঝব কী ভাবে? চলুন দেখি—
• ব্যবসার অন্যতম ভিত্তিই হল, তার ক্রেতা বা গ্রাহক থাকতে হবে। অর্থাৎ, আপনি যে পণ্য বিক্রি করছেন বা পরিষেবা দিচ্ছেন, তা কেনা বা নেওয়ার লোক থাকবে হবে।
• গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহও বজায় থাকতে হবে।
• তাঁরা যাতে পণ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
• সেই গ্রাহক সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হতে হবে ও তাঁদের চাহিদাও উত্তরোত্তর বাড়তে হবে।
• তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্যের বিক্রি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেতে হবে।
• যখন দেখা যাবে যে বর্তমান ব্যবসার যা পরিকাঠামো তা দিয়ে আর গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না, তখন বুঝতে হবে যে ব্যবসা সম্প্রসারণের সময় হয়েছে।
চাহিদা অনুসারে লগ্নি
ব্যবসা বাড়ানোর সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ হল, ক্রেতা বা গ্রাহকের চাহিদার কথা মাথায় রাখা। এ জন্য—
• আগেই বলেছি, ব্যবসা শুরুর সময়ে আপনি কিছুটা নিজের মতো করে এক ভাবে এগোতে পারেন। কিন্তু তা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে মনে রাখতে হবে যে, আপনার ক্রেতা কারা হবেন।
• এই ক্রেতাদের চাহিদা কী কী। তা মেটাতে কতটা পরিমাণ অর্থ আপনাকে লগ্নি করতে হবে এবং বিক্রি কতটা হবে বলে মনে করছেন, সম্প্রসারণের আগে সেই হিসেব করে ফেলা জরুরি।
• নতুন ক্রেতা বা গ্রাহকের নির্দিষ্ট কোনও চাহিদা আছে কি না, খেয়াল রাখতে হবে সেই বিষয়টিও। হয়তো দেখা গেল, সে জন্যই আলাদা করে বেশি টাকা লাগছে।
• দেখতে হবে যে, সেই চাহিদা অনুযায়ী নতুন কোনও পণ্য আনতে হবে, নাকি বর্তমান পণ্যগুলিকেই আরও উন্নত করতে হবে।
• এ সবের উপরেই নির্ভর করবে লগ্নির অঙ্ক।
মনে রাখবেন, উপরের বিষয়গুলি শুধু উৎপাদনই নয়, যে কোনও পরিষেবা ব্যবসা ও তার গ্রাহকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বর্তমান অবস্থা
প্রথমেই দেখতে হবে আপনার চালু থাকা ব্যবসাটি আর্থিক দিক থেকে কতটা মজবুত। অর্থাৎ—
• ওই ব্যবসা থেকে মাসিক আয় কত।
• কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা ও তাঁদের বেতন সুরক্ষিত রেখে মোট কত টাকা মুনাফা থাকছে।
• সেই টাকা দিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যাবে, নাকি বাইরে থেকে আলাদা করে ঋণ নিতে হবে।
• দেখে নেওয়া উচিত যে, কোনও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে বর্তমান ব্যবসাটির ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা কতটা।
কোন মেয়াদের ও কত ঋণ
ধরুন, আপনার ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ১০ লক্ষ টাকা লাগবে। কিন্তু তার পুরোটাই কি ঋণ নেবেন, নাকি কিছুটা কম ধার নিয়েও তা নিয়মিত শোধ দেওয়ার রেকর্ড তৈরি করবেন? এ সব প্রশ্নই মনের মধ্যে আসতে পারে। দেখুন এমনিতে কত টাকা এবং কোন মেয়াদের ঋণ নেবেন, তা আপনার বিষয়। কিন্তু আমি বলব—
• ঋণ সব সময়েই স্বল্প মেয়াদের জন্য ও অল্প পরিমাণে নেওয়া উচিত। ঋণের অঙ্ক সাধারণত নির্ভর করে কেন নিচ্ছেন তার উপরে।
• ঋণ যদি দৈনন্দিন কার্যকরী মূলধন হিসেবে নেওয়া হয়, তা হলে তা হতে পারে স্বল্প মেয়াদের।
• আর ঋণ যদি মূলধন বিনিয়োগের প্রয়োজনে (যেমন, কারখানার যন্ত্রপাতি বা ব্যবসার জন্য অফিসবাড়ি কেনা) নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে ঋণের মেয়াদ সাধারণত লম্বা হতে পারে।
• এক বারে বেশি ঋণের চাপ না-নিয়ে বরং ধাপে ধাপে ধার নিয়ে ব্যবসা বাড়ানোই ভাল।
• সফল ভাবে ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পরিশোধ করে পুনরায় ঋণ নেওয়া উচিত।
রিপোর্ট কী ভাবে
আপনি জানেন আপনার ব্যবসা কী ভাবে, কতটা ভাল বা খারাপ চলছে। কিন্তু ব্যাঙ্ক তো আর তা জানে না। তাই নিজের সংস্থার অবস্থা ভাল ভাবে ব্যাঙ্ককে বোঝানোর জন্য তার সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট হাতের কাছে সব সময়ে তৈরি রাখা জরুরি। কাজটা শুনতে কঠিন। কিন্তু নিয়ম করে করতে পারলে খুব একটা নয়। এখানে বেশ কিছু খুঁটিনাটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে—
• চালু ব্যবসার বাইরে ব্যবসা বাড়ানোর বিশদ বিবরণ দিয়ে একটি প্রজেক্ট রিপোর্ট বানাতে হবে। তাতে থাকবে— প্রতিষ্ঠানের বিবরণ, নতুন কোন পণ্যের ব্যবসা করতে চান, লগ্নির খুঁটিনাটি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা (যেমন, ৫ বছরের মধ্যে ব্যবসার ক্ষমতা বাড়ানো, ব্যবসায় লগ্নি করে আয়ের ব্যবস্থা) ইত্যাদি।
• রিপোর্টে তৎকালীন বাজারের অবস্থা, বাজারের প্রবণতা কোন দিকে, সামগ্রিক ভাবে ব্যবসার পরিবেশ কেমন, তা জানতে হবে।
• অন্যান্য সংস্থা যারা একই পণ্যের ব্যবসায় যুক্ত, তাদের তুলনামূলক বিচারের বিবরণ থাকতে হবে।
• থাকতে হবে দৈনন্দিন ব্যবসা পরিচালনা করার পরিকল্পনাও।
• ব্যবসা চালাতে কোন দক্ষতার ও কত জন কর্মী লাগবে, তার বিবরণ দিতে হবে। কর্মী ও আপনার নিজের কর্মদক্ষতার বর্ণনা থাকলে ভাল।
এক বার এই রিপোর্ট তৈরি করেই থেমে গেলে চলবে না। বরং আমার মতে, নিয়মিত সেই রিপোর্ট আপডেট করে যাওয়া উচিত। তা হলে যত বার ঋণ নিতে যাবেন, নতুন করে পুরোটা তৈরি করতে হবে না। বরং যতটা দরকার, সেই তথ্যগুলি জুড়লে বা পাল্টালেই হবে। এতে এক দিকে খাটনি কমবে আবার অন্য দিকে দ্রুত ঋণের আবেদন করতেও সুবিধা হবে।
ঋণের জন্য
যদি হাতে টাকা থাকে তো ভাল, না-হলে ব্যবস্থা করতে হবে ঋণের। এর জন্য বেশ কিছু নথি আগেই তৈরি করে রাখতে হবে। সেগুলি হল—
• অবশ্যই ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে রাখা উচিত।
• ব্যবসার জন্য নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা দরকার এবং সেই অ্যাকাউন্টে নিয়মিত লেনদেনের প্রমাণ থাকা জরুরি।
• জিএসটি রেজিস্ট্রেশন করতে হবে এবং নিয়মিত জিএসটি দেওয়ার স্টেটমেন্ট থাকতে হবে।
• প্যান কার্ড অবশ্যই থাকা দরকার।
• গত কয়েক বছরের (সাধারণত তিন বছরের দেখতে চাওয়া হয়) আয়কর রিটার্নের ফাইল থাকতে হবে।
• এর আগে যদি কোনও ঋণ নেওয়া হয়ে থাকে, তা হলে সেই ঋণ নিয়মিত শোধ করারও রেকর্ড থাকতে হবে।
উপরে উল্লিখিত নথিগুলি তৈরি থাকলে সাধারণত ঋণদাতার সুবিধা হয় ঋণ অনুমোদন করতে। প্রথম বার ঋণের জন্য তো বটেই। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য এগুলি হাতে কাছে তৈরি থাকা জরুরি।
কোথা থেকে
যে কোনও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, সমবায় (কোঅপারেটিভ) ব্যাঙ্ক ও ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফসি) থেকে এই ঋণ পাওয়া যায়।
ব্যাঙ্ক কী দেখে
ব্যাঙ্ক নিজের তহবিল থেকে আপনাকে টাকা দেবে, ফলে তার আগে তারাও দেখে নেবে সেই টাকা দেওয়া কতটা সুরক্ষিত। এ জন্য মূলত যে যে বিষয়ে তারা জোর দেয়, সেগুলি হল—
• আবেদনকারীর ঋণ শোধ করার সামর্থ রয়েছে কি না।
• বর্তমান ব্যবসায় কী পরিমাণ অর্থ ইতিমধ্যেই লাগানো হয়েছে।
• ক্রেডিট ব্যুরোর খাতায় আবেদনকারীর ঋণ শোধের রেকর্ড ভাল কি না।
• বাজারের আর্থিক পরিস্থিতি সেই মুহূর্তে কেমন।
• মূল্যায়ন করা হয় আবেদনকারীর ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট ও তাঁর ব্যবসার ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট।
• এ ছাড়াও আবেদনকারীর মাসিক নগদের জোগান কত, তার বিশ্লেষণ করে ব্যাঙ্ক। প্রতি মাসের লেনদেন থেকে যে টাকা আয় হয়, তার থেকে ব্যবসার কাঁচামাল বা পণ্য ক্রয় করে ও সংসার চালিয়ে কত টাকা থাকে, তার হিসেব করা হয়। দেখা হয় সেই অর্থ দিয়ে কতটা পরিমাণ ঋণের মাসিক কিস্তি শোধ করা যাবে। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী কত টাকা ঋণ মঞ্জুর করা সম্ভব, তা ঠিক করে ব্যাঙ্কগুলি।
সুদের হার
সুদের হার নির্ধারণ করার জন্য ঋণদাতারা সাধারণত কয়েকটি বিষয় বিশ্লেষণ করে। যেমন—
• আবেদনকারী ও সংস্থার অতীতে নেওয়া ঋণের স্টেটমেন্ট, তাঁর ঋণ শোধের রেকর্ড।
• সংস্থার আয়-ব্যয়ের হিসেব।
• আবেদনকারীর ব্যবসাটি যে শিল্প ক্ষেত্রের আওতায় পড়ে (যেমন, ইস্পাত, নির্মাণ, আবাসন, দোকান, পরিষেবা ইত্যাদি), সেই ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার ঝুঁকি কতটা।
• ব্যাঙ্কের মুনাফা কত হতে পারে।
• ঋণদাতা সংস্থার মোট তহবিলের জন্য ব্যয় কত হয়।
• ওই সময়ে ঋণদাতার তহবিল সংগ্রহের ভিত্তিতে ঋণে হিসেব করা সুদের হার (এমসিএলআর) কত।
• এই সমস্ত মূল্যায়নগুলির পরে ঋণদানের ঝুঁকি বিচার করে সুদের হার স্থির করা হয়।
এ সবের উপরেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ থাকে। তবুও ঝুঁকি-সহ বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণের পরে এক গ্রাহকের থেকে অন্য গ্রাহকের সুদের হার পৃথক হতে পারে।
ধার নেওয়ার পরে
এক বার ঋণ পেয়েই ঝামেলা শেষ, তা কিন্তু নয়। এ বারই শুরু হবে আসল কাজ। মনে রাখবেন, সব টাকা একসঙ্গে লগ্নি করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমার মতে বরং—
• প্রথমে প্রতিষ্ঠানের নগদ সম্পত্তি তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ, যে বরাত এসেছে, ঋণের টাকা দিয়ে তা পূরণ করে হাতের টাকা জোগাড় করা বা নতুন পণ্য মজুত ভান্ডারে আনার পরে তা বিক্রি করে মুনাফা করার দিকে মন দিতে হবে। পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত থাকলে তা কিছুটা বাড়ানোর পথে হাঁটা ইত্যাদি।
• এর পরের ধাপে স্থাবর সম্পত্তি তৈরির চেষ্টা করতে হবে। যেমন, যদি এত দিন ভাড়া নেওয়া জায়গায় ব্যবসা চালান অথবা কারখানা থাকে, এ বার ভাবতে পারেন নিজের জমি বা বাড়ি কেনার কথা।
ভবিষ্যতের জন্য
ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ধার তো পেলেন। তবে সেই টাকা হাতে পেয়েই কাজ শেষ তা নয়। এর পরেও আরও টাকা লাগতে পারে। তাই—
• নিয়মিত ঋণের কিস্তি শোধ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এতে ক্রেডিট ব্যুরোতে আবেদনকারীর ভাল রেকর্ড বজায় থাকবে। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তীকালে আবার ঋণ পেতেও সুবিধা হবে।
• ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে অদূর ভবিষ্যতের আর্থিক সমস্যা সামাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট টাকা রেখে দেওয়া ভাল।
• ব্যাঙ্কের চাহিদা মতো সময় সময় ঋণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা করতে হবে।
• ঋণের ব্যবহারের শংসাপত্র ব্যাঙ্কে জমা করা দরকার।
উপরে বলা বিষয়গুলি মাথায় রাখলে এবং সেই মতো প্রস্তুতি নিলে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও ব্যবসার উন্নতিতে বাধা কিছুটা কাটবে।
লেখক বন্ধন ব্যাঙ্কের এমডি-সিইও
(মতামত ব্যক্তিগত)