চাকরির আকাল। সুরাহার লক্ষ্যে সরকার চাইছে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহ দিতে। উদ্দেশ্য, তরুণ-তরুণীরা শুধু যে কাজ চাইবেন তা-ই নয়। তাঁদের একটা অংশ কাজ দেওয়ার স্বপ্নও দেখবেন। একেবারে নিজেদের ব্যবসায়। আজকাল অনেকে ছোট করে ব্যবসায় পা রাখতেও চাইছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের একটা অংশের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পুঁজির অভাব। আমানত ভাঙিয়ে ব্যবসায় ঢালার ঝুঁকি ক’জনের পক্ষেই বা নেওয়া সম্ভব? তা ছাড়া সেই আমানত তো আর সবার কাছে থাকেও না! ভাবী উদ্যোগপতিদের এই অংশের সমস্যার সমাধানের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি উপায়। তার মধ্যে অন্যতম হল প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আনাজের দোকান খোলা বা কারখানাকে বাড়িয়ে তোলার মতো ছোটখাটো ক্ষেত্রেও এই প্রকল্পের আওতায় ঋণ পাওয়া সম্ভব।
এই প্রকল্পে ঋণ পাওয়ার জন্য বাড়তি কোনও সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয় না। অর্থাৎ, যে দোকানের জন্য ধার নিচ্ছেন, তা হয়তো বন্ধক থাকল। কিন্তু তা বলে বাড়িও বন্ধক রাখতে হবে না।
কেন মুদ্রা প্রকল্প
যাঁরা ব্যবসা শুরু করতে চান তাঁদের জন্য পুঁজি বা ঋণের বন্দোবস্ত নেই, এমনটা কিন্তু নয়। স্বনির্ভরতার পথে পা বাড়ানোয় সহায়তা দিতে কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। আছে নানান রকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। কিন্তু সেই প্রকল্পের তথ্য কিংবা তার দরজা খোলার চাবির খোঁজ অনেক সময়েই আমাদের কাছে থাকে না। যেমন, ব্যবসার জন্য ঋণ পেতে কোথায় আবেদন জানাতে হবে এবং কী কী কাগজপত্র লাগবে, সেই ধারণা নেই অনেকেরই। তাই বহু দৌড়ঝাঁপ করেও হাতে আসে না পুঁজি। অনেক ক্ষেত্রে আবার বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিপুল বন্ধকের বাধ্যবাধকতা। তখন বাধ্য হয়ে পরিচিত কারও কাছে চড়া সুদে ধার নেন অনেকে। কেউ কেউ আবার হাত পাতেন মহাজনের কাছে। তাই ইদানীং সরকারি ঋণের সহজ ঠিকানাটা জেনে রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই উদ্দেশ্যেই এই নিবন্ধ।
সাধারণত কোন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন নতুন উদ্যোগপতিরা?
• মূলধনের অভাব।
• বন্ধক দেওয়ার মতো সম্পত্তি না-থাকা।
• ঋণ পেতে গেলে যে ধরনের পদক্ষেপ করতে হয়, সে সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব।
• সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সঠিক প্রশিক্ষণ না-থাকা।
• সংস্থা পরিচালনার দক্ষতা তৈরি না-হওয়া।
• প্রযুক্তি ও তার ব্যবহার সম্পর্কে ধারণার অভাব।
এই সমস্ত সমস্যার মধ্যে প্রথম তিনটির সমাধানের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা (পিএমএমওয়াই) চালু করে কেন্দ্র। লক্ষ্য, পুঁজির অভাবে যাঁরা ব্যবসা শুরু করতে কিংবা সম্প্রসারণ করতে পারছেন না, তাঁদের হাতে পুঁজি তুলে দেওয়া। নিয়ে আসা সংগঠিত আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে। কারণ সংস্থা পরিচালনা, প্রশিক্ষণ বা প্রযুক্তির ব্যবহার শিখে এলেও মূলধন না-থাকলে ব্যবসা চালুই করা যাবে না।
এই লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় মাইক্রো ইউনিটস ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফাইনান্স এজেন্সি লিমিটেড (মুদ্রা)। এটি আদতে ব্যাঙ্ক নয় এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা এনবিএফসি। যার কাজ ছোট সংস্থাগুলিকে ব্যবসায় মূলধন দিয়ে সাহায্য করা। আদতে ভাবী উদ্যোগপতিরা ঋণ নেন ব্যাঙ্ক, ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা কিংবা এনবিএফসি থেকে। ঋণের সর্বোচ্চ অঙ্ক ১০ লক্ষ টাকা।
গ্রাম ভারতের যে সমস্ত দুর্গম কোণায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছয়নি, মুদ্রা ব্যাঙ্কের তহবিল থেকে সেখানকার উদ্যোগপতিদেরও সাহায্য করা হয়। এর জন্য কাজে লাগানো হয় বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। যার মধ্যে রয়েছে এনবিএফসি, সমবায় ব্যাঙ্ক, ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা। যেখানে যেখানে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক রয়েছে, সেখানে তারাও মুদ্রা ব্যাঙ্কের হয়ে ঋণ বিলি করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে মুদ্রা ব্যাঙ্ক একই পরিমাণ টাকা মিটিয়ে দেয়। যাতে কোনও সময়েই তাদের পুঁজির জোগান দিতে সমস্যা না-হয়।
মুদ্রা প্রকল্প ভবিষ্যতে গ্রামীণ অর্থনীতির গতি বাড়াতে সাহায্য করবে বলে সরকারের আশা। এই প্রকল্পে আগ্রহ বৃদ্ধিও সে রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। (দেখুন উপরের সারণিতে)
মুদ্রার বিভিন্ন দিক
কৃষির পরেই দেশের বৃহত্তম আর্থিক ক্ষেত্র হল ক্ষুদ্র শিল্প। প্রায় ১০ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে। পরিবার পরিজনের হিসেব করলে প্রায় ৫০ কোটি মানুষের রুজিরুটি নির্ভর করে এই ক্ষেত্রটির উপরে। মূলত কলকারখানায় উৎপাদন, ছোট ব্যবসা, প্রক্রিয়াকরণ, বিভিন্ন পরিষেবা জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে। অর্থাৎ, দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি এই ক্ষেত্র। অথচ দেশে তো বটেই, ভারতের এই ক্ষেত্রটি সারা বিশ্বের বৃহত্তম অসংগঠিত ক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃত।
পরিসংখ্যান মন্ত্রকের অধীনে থাকা ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের (এনএসএসও) ২০১৩ সালের এক সমীক্ষা বলছে, দেশে ছোট উদ্যোগের সংখ্যা প্রায় ৫.৭৭ কোটি। এর ছোট একটি অংশ ব্যাঙ্কিং পরিষেবার মাধ্যমে পুঁজি পায়। কিন্তু বড় অংশই রয়ে গিয়েছে সংগঠিত আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে। কেন্দ্র মনে করছে, বাকিদের সংগঠিত শিল্প ঋণের আওতায় নিয়ে আসা হলে, ভবিষ্যতে তারা গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। কাজ করতে পারে কর্মসংস্থান তৈরি এবং জিডিপি বৃদ্ধির যন্ত্র হিসেবে।
ঋণের ধরন
ঋণের অঙ্কের নিরিখে মুদ্রা প্রকল্পকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
• শিশু: যাঁদের ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত মূলধন প্রয়োজন, তাঁরা এই ‘শিশু’ প্রকল্পে ঋণের আবেদন করতে পারেন।
• কিশোর: ৫০,০০০ টাকার বেশি থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ মেলে এই প্রকল্পে।
• তরুণ: এতে ঋণের অঙ্ক হয় ৫ লক্ষের বেশি থেকে ১০ লক্ষ টাকা।
কারা পাবেন ঋণ
আগেই বলা হয়েছে, নতুন ব্যবসা শুরু করতে বা সম্প্রসারণের জন্য মুদ্রা প্রকল্পের অধীনে ঋণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে:
• ছোট কারখানা।
• দোকান।
• ফল ও আনাজ বিক্রি।
• হস্তশিল্প ও কারিগরির কাজ।
• বাণিজ্যিক গাড়ি কেনা।
• কার্যকরী মূলধন জোগাড়।
• কারখানা এবং মেশিন কেনা।
• ব্যবসার জায়গা সাজানো ও সারানো।
• বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এবং গ্রামীণ শিল্পের জন্য ওভারড্রাফটের ব্যবস্থা করতেও ঋণ মেলে এই প্রকল্পে।
কোন ক্ষেত্রে ঋণ মিলবে না
• ১০ লক্ষ টাকার বেশি অঙ্কের ঋণে।
• কৃষি ঋণে।
• ব্যবসা নয় এমন কোনও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। যেমন, ব্যবসায়িক কার্যকলাপের জন্য বাণিজ্যিক গাড়ি কিনলে তার জন্য মুদ্রা ঋণ মিলতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে এই ঋণ মিলবে না।
ঋণের যোগ্যতা
• ন্যূনতম বয়স হতে হবে ১৮ বছর।
• খুলতে হবে নতুন ব্যবসা। কিংবা পুরনো ব্যবসাকে আড়েবহরে বড় করার স্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে।
• শুধু ছোট সংস্থাই এ জন্য আবেদন করতে পারবে।
সুদ কেমন
আগেই বলেছি, দেশের ভাবী উদ্যোগপতিরা প্রথাগত ঋণ না-পেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই চড়া সুদে চেনাশোনা লোক কিংবা মহাজনের থেকে ঋণ নেন। তার বদলে প্রথাগত ঋণ ক্ষেত্রে তাঁদের নিয়ে আসার জন্যই তৈরি হয়েছে মুদ্রা যোজনা। সে কারণে এই প্রকল্পে সুদের হার অন্যান্য ঋণের তুলনায় অনেকটাই কম। এমনকি কম ক্ষুদ্র ঋণের কিংবা বেসরকারি ঋণের চেয়ে। নীচের সারণিতে এক বার দেখে নিন (সুদের হার কোথায় কত)।
আবেদন কী ভাবে
মুদ্রা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে তহবিলের জোগান দেওয়া হলেও সেই ঋণ পাওয়া যায় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি থেকেই। এনবিএফসি, ট্রাস্ট-সহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও পাওয়া যায় ওই ঋণ। আবেদনও করতে হয় সেখানেই।
• কী ধরনের ব্যবসা করতে চান তা বুঝিয়ে কাগজপত্র জমা দিতে হবে ঋণের আবেদনের সঙ্গেই।
• ব্যাঙ্কের নির্দেশ অনুযায়ী দিতে হবে ব্যবসা সংক্রান্ত বাদবাকি কাগজ। যেমন, প্যান, যোগ্যতার প্রমাণপত্র (তা শিক্ষাগত যোগ্যতাও হতে পারে)।
নথিপত্র কী কী
মুদ্রা যোজনায় দু’ভাবে ঋণ মেলে। এক, কিস্তিতে। দুই, গোষ্ঠী হিসেবে এবং গ্রামীণ ব্যবসায়। দু’ক্ষেত্রে নথিপত্রের ধরন দু’রকম।
কিস্তিতে ঋণ
• প্রকল্পের আবেদনপত্র এবং কিস্তিতে ঋণ নেওয়ার ফর্ম দু’টিই ঠিক ভাবে পূরণ করতে হবে।
• ছবি-সহ পরিচয়পত্র এবং ঠিকানার প্রমাণপত্র।
• ব্যবসার প্রমাণ।
• শেষ ছ’মাসের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট।
• ব্যবসা যে আপনার নামেই, তার প্রমাণপত্র। নইলে অন্তত বাড়ি এবং অফিসের ঠিকানার প্রমাণপত্র।
• কোনও ধরনের কারিগরি শিক্ষা নিয়ে থাকলে, তার যোগ্যতার সার্টিফিকেট।
• ট্রেড লাইসেন্স সংক্রান্ত কাগজপত্র।
গোষ্ঠী হিসেবে/গ্রামীণ ব্যবসায়
• প্রকল্পের আবেদনপত্র এবং বিজনেস ইনস্টলমেন্ট লোন অথবা রুরাল বিজনেস ক্রেডিট আবেদনপত্র ভর্তি করে জমা দিতে হবে।
• ছবি-সহ পরিচয়পত্র এবং ঠিকানার প্রমাণপত্র।
• ব্যবসা যে আপনার নামেই, তার প্রমাণপত্র। অথবা বাড়ি এবং অফিসের ঠিকানার প্রমাণপত্র।
• কত দিন ধরে ব্যবসা করছেন, তার প্রমাণপত্র।
• শেষ ১২ মাসের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট।
• শেষ দুই বছরের আয়কর রিটার্ন দাখিলের নথি।
মুদ্রা কার্ড
প্রত্যেক ঋণগ্রহীতাকে একটি করে মুদ্রা কার্ড দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ব্যাঙ্কে না-গিয়েও এটিএম থেকে ঋণের টাকা তোলা যায়। আবার যন্ত্রপাতি কেনার সময়ে সরাসরি এই কার্ড ব্যবহার করেও টাকা মেটানো সম্ভব। যদি কোনও সময় হাতে বাড়তি টাকা আসে, তা হলে এই কার্ডের মাধ্যমেই তা অ্যাকাউন্টে জমা করা যায়। এ ভাবে কমানো যায় আসল ও সুদের পরিমাণ।
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের মধ্যে ভারতের অর্থনীতিকে ৫ লক্ষ কোটি ডলারে নিয়ে যেতে চাইছে কেন্দ্র। কিন্তু গ্রামের দিকে কর্মসংস্থান এবং কেনাকাটার ক্ষমতা এখনও প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছয়নি। এর ফলে জীবনের মানের পাশাপাশি জিডিপি-ও যে ধাক্কা খেতে পারে, সে সম্পর্কে কেন্দ্র ভাল রকম ওয়াকিবহাল। এর জন্য কৃষি ও শিল্পের দিকে সমান গুরুত্ব দিতে চাইছে সরকার। কিন্তু কৃষি ক্ষেত্রের একটা মৌলিক সমস্যা হল, এর জমি কোনও ভাবেই আর বাড়ানো সম্ভব নয়। উল্টো দিকে শিল্পোৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রেকে গ্রামের দিকে বাড়িয়ে তোলার সুযোগ কিন্তু এখনও যথেষ্ট রয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারলে বাড়বে কর্মসংস্থান এবং গ্রামের বাজার। এ বার এই ক্ষেত্রটিকেই গতিশীল করতে চাইছে সরকার। সেই লক্ষ্যেই ঋণের জোগানের দিকে ইদানীং জোর দেওয়া হচ্ছে।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)