পেনশন নিতে হুড়োহুড়ি ব্যাঙ্কের বাইরে। বুধবার আথেন্সে। ছবি: এএফপি।
ভাঙবেন তবু মচকাবেন না।
গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাসের একগুঁয়ে মনোভাব সম্পর্কে এই মন্তব্যই করেছে তার ইউরোপীয় ঋণদাতারা। ত্রাণ পেতে কিছুটা সুর নরম করেও পরে আবার নিজের নীতিতেই অটল থেকে বুধবার ফের রণমূর্তি ধরলেন সিপ্রাস। সরকারি খরচ কমানো, কর বাড়ানোর শর্তে ত্রাণ প্রকল্প মেনে নেওয়ার বিপক্ষে টেলিভিশন ভাষণে জোরালো সওয়াল করলেন তিনি। রবিবার ৫ জুলাইয়ের গণভোটে জনগণকে ত্রাণ প্রকল্পে ‘না’ বলতেই নতুন করে আহ্বান জানালেন তিনি। অভিযোগ আনলেন, শর্ত আরোপ করে গ্রিসকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করছে ঋণদাতারা।
এই পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের মধ্যে বৈঠকে গণভোটের আগে পর্যন্ত আলোচনার সব দরজাই বন্ধ করে দিলেন ঋণদাতারা। জার্মানি আগেই জানিয়েছিল, তারা নতুন করে আলোচনায় ফিরতে নারাজ। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক এক ট্যুইট-বার্তায় বলেন, ‘‘ইউরোপ গ্রিসকে সাহায্যের হাত বাড়াতে প্রস্তুত। কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো কাউকে সাহায্য করা যায় না।’’
অথচ তথাকথিত উন্নত দুনিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে আইএমএফের খাতায় ঋণখেলাপি বলে নাম উঠেছে গ্রিসের। মঙ্গলবারের সময়সীমার মধ্যে ১৬০ কোটি ডলার আইএমএফ ঋণ ফেরত দিতে পারেনি অর্থ সঙ্কটে ধুঁকতে থাকা গ্রিস। আর্থিক সংস্কারের পথে না-হেঁটে ত্রাণ প্রকল্পের বিপক্ষে ভোট দিলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে হবে প্রায় দেউলিয়া গ্রিসকে। সরকারের ভাঁড়ার ফাঁকা, নগদের অভাবে ব্যাঙ্ক বন্ধ, থমকে শেয়ার লেনদেন, ক্ষুব্ধ পেনশনপ্রাপকরা সরকারের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। এই পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবারই গ্রিস নতুন করে ২৯১০ কোটি ইউরো (২ লক্ষ ৩৭০০ কোটি টাকা) অনুদানের জন্যও আর্জি জানায়। এই অর্থ দিয়েই আগামী দু’বছরে গ্রিস যাবতীয় ঋণ মেটাতে পারবে বলে দাবি ছিল সিপ্রাসের। কিছুটা সুর নরম করে ত্রাণ প্রকল্প মেনে নিতে কয়েকটি শর্ত জানিয়ে ইউরোপীয় ঋণদাতাদের কাছে লিখিত আর্জিও দাখিল করেছিলেন সিপ্রাস। তাঁর শর্তগুলি ছিল:
• গ্রিসের দ্বীপগুলিতে যুক্তমূল্য করে ৩০ শতাংশ ছাড় বহাল রাখা
• ২০১৫-র অক্টোবর পর্যন্ত দরিদ্র পেনশনপ্রাপকদের অনুদান না-কমানো
• প্রতিরক্ষা খাতে খরচ কমানোয় বাড়তি সময়
এর জেরে বাদবাকি ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক আবার কিছুটা ভাল হলে রফার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে বলে মনে করছিলেন বিশেষজ্ঞরা। আর, তার পরেই প্রধানমন্ত্রী আচমকা ঘুরে যাওয়ায় হতবাক তাঁরা। হতাশ ঋণদাতারাও।
এ দিকে, দৈনন্দিন খরচ চালাতে নাজেহাল হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ পেনশনপ্রাপক এ দিন গ্রিসের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ঘেরাও করে প্রতিবাদ জানান। সরকার নগদের অভাবে এক সপ্তাহ ব্যাঙ্ক বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও পেনশন মেটানোর জন্যই বুধবার বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ১ হাজারটি শাখা অল্প সময়ের জন্য খোলা হয়। যাঁদের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড নেই, সেই সব অবসরপ্রাপ্তদেরই সপ্তাহের বাকি দিনগুলির খরচ চালাতে ১২০ ইউরো (৮৪০০ টাকা) করে তোলার অনুমতি দেওয়া হয়। সাধারণ নাগরিকরা প্রতিটি ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড মারফত দিনে ৬০ ইউরো করে তোলার অনুমতি পেলেও বেশির ভাগ পেনশনপ্রাপকেরই কোনও কার্ড নেই। তাঁরা নগদেই পেনশন তোলেন ও খরচ মেটান। পেনশন তুলতে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে জনৈক বৃদ্ধকে বলতে শোনা যায়, ‘‘জাহান্নমে যাক ঋণ পাওয়া নিয়ে রফা। এখন এ দেশে দিন কাটানোই কঠিন।’’ একজন অবসরপ্রাপ্ত নৌসেনা বলেন, ‘‘৫০ বছর সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে চাকরি করে এখন আমি ভিখারি!’’
প্রসঙ্গত, ত্রাণ প্রকল্প চালু রাখার জন্য ইউরোপীয় ঋণদাতারা যে-সব শর্ত বেঁধে দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে: ১) জুলাই থেকে যুক্তমূল্য কর (ভ্যাট) চালু করে রাজস্ব বাড়িয়ে জাতীয় আয়ের ১% করা। ২) ওই করের হার বাড়িয়ে ২৩ শতাংশে ধার্য করা। ৩) জল, বিদ্যুৎ, খাদ্য হোটেলে তা ছাড় দিয়ে ১৩ শতাংশে রাখা। ৪) ওষুধ, বইপত্র, থিয়েটারে মাত্র ৬% কর। ৫) দ্বীপগুলিতে করছাড় তুলে নেওয়া। ৬) আগাম অবসর বন্ধ করা। ৭) ২০২২-এর মধ্যে অবসরের বয়স বাড়িয়ে ৬৭ করা। ৮) গরিব পেনশনপ্রাপকদের বাড়তি অনুদান বন্ধ করা। এই সব শর্তেই কিছুটা ছাড় চেয়েছিলেন সিপ্রাস।
শর্তসাপেক্ষে গ্রিস ত্রাণ প্রকল্প গ্রহণ করবে বলে সকালের দিকে ঘোষণা করায় শেয়ার বাজার উৎসাহিত হয়ে ওঠে। বুধবার বিশ্ব জুড়েই বিভিন্ন শেয়ার সূচকের মুখ উপরের দিকে ছিল। এ দিন ভারতে সেনসেক্স বেড়েছে ২৪০.০৪ পয়েন্ট। বাজার বন্ধের সময়ে সূচক থিতু হয় ২৮,০২৮.৮৭ অঙ্কে। দীর্ঘ আড়াই মাস পরে সেনসেক্স ফের ২৮ হাজারের ঘরে ঢুকল।
ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে মূলধন জুগিয়ে সাহায্য করা হবে বলে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতিও এ দিন বাজারকে চাঙ্গা হতে সাহায্য করেছে। গত দু’দিনের লেনদেনেই সেনসেক্সের উত্থান ৩৭৫ পয়েন্টের বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিছু শর্ত মানলে তাদের ত্রাণ প্রকল্প গ্রিস মেনে নিতে রাজি হওয়ায় ওই দেশের ঋণ মেটানোর সমস্যায় রফাসূত্র মেলার ব্যাপারে কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠেছিল লগ্নিকারীরা। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ার দরে। খোলার পরে চাঙ্গা ছিল মার্কিন বাজারও। তবে সিপ্রাসের মত বদলের প্রভাব বাজারে কাল পড়তে পারে।