নিজের ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করতে চান সুজন। টাকাও জমিয়েছেন বেশ কিছুটা। কিন্তু আটকে গিয়েছেন বাকি পুঁজি জোগাড়ের প্রশ্নে। শুনেছেন যে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন অনুসারে ছোট ব্যবসার জন্য নানা ধরনের ঋণ পাওয়ার সুবিধা রয়েছে। কিন্তু সেগুলি সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা নেই বলে বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁর জন্য কোন ধরনের ঋণ উপযুক্ত। সুজনের মতো এমন অবস্থা অনেকেরই হয়। ব্যবসার কোন ধরনের কাজে ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ মেলে, সরকারি প্রকল্প রয়েছে কি না, সে সব জানেন না বহু মানুষ। পুঁজির সংস্থানের প্রশ্ন আসলেই তাই দিশেহারা হয়ে পড়েন তাঁরা। তাঁদের জন্য আজকের আলোচনা। দেখে নেওয়া পুঁজি জোগাড়ের বিভিন্ন পথ।
কোন খাতে কী
ঋণের কথা উঠলেই প্রথমে মনে হয় ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কথা। ব্যবসা শুরু বা বাড়ানোও ব্যতিক্রম নয়। একটা ব্যবসা চালুর সময়ে বিভিন্ন কাজের জন্য ঋণ পাওয়া যায়। তা হতে পারে কার্যকরী মূলধন জোগানো বা সংস্থার দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য নেওয়া ঋণ, দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ, রফতানি বা আমদানির জন্য নেওয়া ঋণ ইত্যাদি। কখন কী ধরনের ঋণ মেলে, তাতেই নজর দেব।
মেয়াদি ঋণ
ব্যবসা চালু ও বাড়ানোর জন্য এই ধরনের ঋণ দেয় ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি।
যে যে ক্ষেত্রে এই ঋণ মেলে তা হল—
• প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কারখানার যন্ত্রপাতি, বাড়ি প্রভৃতি কেনা।
• কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো, নতুন পণ্য বাজারে আনা, কারখানার আধুনিকীকরণ ইত্যাদি।
• সাধারণত, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই ঋণ পাওয়া যায়।
• সংস্থার সম্ভাব্য আয় ধরে ঋণের অঙ্ক স্থির হয়।
• যে সমস্ত যন্ত্র কিনতে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলি বন্ধক রাখতে হয়। তা ছাড়াও সংস্থার প্রোমোটারকে বাড়তি সম্পদ বন্ধক রাখতে হতে পারে।
• মূলধনের ১০%-২৫% মার্জিন মানি হিসেবে প্রোমোটারকে লগ্নি করতে হয়। তবে তা ঠিক কত হবে, সেই অঙ্ক কত হবে, তা নির্ভর করে সংস্থার দরাদরি করার ক্ষমতা এবং আর্থিক পরিস্থিতির উপরে।
কার্যকরী মূলধন
সংস্থার দৈনিক কাজকর্মের জন্য এই ঋণ নেওয়া যায়।
• সাধারণত ক্যাশ ক্রেডিট বা ওভারড্রাফটের মাধ্যমে এই ঋণ দেওয়া হয়।
• এর সাহায্যে কাঁচামাল কেনা-সহ বিভিন্ন খাতে টাকা পাওয়া যায়।
• ঋণের অঙ্ক স্থির হয় সংস্থার বর্তমান সম্পদ ধরে। যার মধ্যে থাকে— তৈরি করা পণ্যের পরিমাণ, কাঁচামাল, কতটা কাজ এগিয়েছে, ক্রেতার থেকে পাওয়া টাকা ইত্যাদি।
• সংস্থার প্রোমোটারকেও মোট কার্যকরী মূলধনের একাংশ (প্রায় ২৫%) দিতে হয় মার্জিন মানি হিসেবে। অর্থাৎ, সংস্থার কার্যকরী মূলধন যদি ১০০ টাকা হয়, তা হলে ব্যাঙ্ক দেবে ৭৫ টাকা। বাকিটা দেবেন প্রোমোটার (আনুমানিক হিসেব সারণিতে)।
রফতানির জন্য
সাধারণত এই ঋণ প্যাকিং ক্রেডিট ফেসিলিটি বলে পরিচিত। এই ঋণ নেওয়া যায়—
• কাঁচামাল জোগাড়, পণ্য তৈরি বা প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং ও পণ্য পাঠানোর জন্য।
• বরাতের অঙ্কের ভিত্তিতে নেওয়া যায় প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিটও।
• চাইলে তা নেওয়া যায় লেটার অব ক্রেডিট (এলওসি) হিসেবে।
• ভারতীয় টাকা অথবা বিদেশি মুদ্রায় ঋণের টাকা দেওয়া হয়।
• সাধারণত ঋণে সুদের হারে কিছুটা ছাড় মেলে।
আমদানির লক্ষ্যে
রফতানির মতো আমদানির জন্যও ঋণ নেওয়া যায়। তা মেলে—
• ভোগ্যপণ্য বিদেশ থেকে আনতে।
• কাঁচামাল জোগাড়ের জন্য।
বিল ডিসকাউন্টিং
কোনও সংস্থা নিজের পাওনার জন্য বসে না-থেকে এই ঋণ নিতে পারে। একটু সহজ করে বললে—
• ধরা যাক, ক সংস্থা পণ্য সরবরাহ করেছে খ সংস্থাকে। এ জন্য দু’মাসে তারা খ সংস্থার থেকে ১০,০০০ টাকা পাবে। তারা চাইলে ওই দু’মাস অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু তাতে টাকা আটকে থাকবে। সে ক্ষেত্রে ক সংস্থা চাইলে ব্যাঙ্কের কাছে ওই ১০,০০০ টাকা ঋণের আর্জি জানাতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রথম সংস্থা সঙ্গে সঙ্গে টাকা পেয়ে যাবে। আর ওই দু’মাসের মেয়াদ হলে খ সংস্থা সরাসরি ব্যাঙ্ককেই টাকা দেবে।
• এই ধরনের ঋণে সুদ, মার্জিন মানির হার কত হবে বা অন্যান্য শর্ত কী হবে, তা ব্যাঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হয়।
• সাধারণত সুদ ১০%-১৫% হয়।
টাকা ছাড়াও অন্যান্য ভাবে
সরাসরি টাকা দিয়ে সাহায্য করা ছাড়াও ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসার জন্য নানা সাহায্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে—
• লেটার অব ক্রেডিট, ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি, সলভেন্সি সার্টিফিকেট ইত্যাদি।
• কাঁচামাল বা তৈরি পণ্য কেনা বা আমদানি, মূলধন জোগাড়ের মতো ক্ষেত্রে লেটার অব ক্রেডিট লাগে।
• তা ব্যবহার করা হয় বিদেশে করার ক্ষেত্রেও। বিশেষত আমদানির জন্য।
• ব্যবসার মরসুম অনুসারে এগুলির মেয়াদ ৩-৬ মাস হতে পারে।
• কোনও বরাত অন্য সংস্থাকে দিলে, তাদের পাওনা হিসেবে অনেক সময়ে ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি দেওয়া হয়। এগুলিকে পারফরম্যান্স গ্যারান্টি বা অ্যাডভান্স গ্যারান্টিও বলে।
ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য
• বিদেশের ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে এই ধরনের বায়ার্স বা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের ব্যবস্থা করে ব্যাঙ্কগুলি।
• সংস্থাগুলির আমদানি খরচ কমাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা মেনে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বাণিজ্যিক গাড়ি কেনা
ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রে পণ্য পাঠানো, কাঁচামাল সরবরাহ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে গাড়ি লাগে। সে জন্যও অনেক সময়ে বাণিজ্যিক গাড়ি কিনতে ঋণ দেয় ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি।
ঋণের সুদে ভর্তুকির প্রকল্প
২০১৮ সালে প্রথম এই প্রকল্প চালু করেছিল কেন্দ্র। ছোট ও মাঝারি শিল্প যাতে সহজে ঋণ পেতে পারে, তারই ব্যবস্থা করা হয়েছে এর মাধ্যমে।
কী লাগবে
যে সমস্ত ছোট সংস্থা এতে নাম লেখাতে চায়, তাদের থাকতেই হবে—
• উদ্যোগ আধার নম্বর (ইউএএন)।
• জিএসটিএন নম্বর।
বৈশিষ্ট্য
• চলতি অর্থবর্ষের মধ্যে প্রকল্পে যোগ দিতে হবে।
• এই ঋণ নেওয়া যাবে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি থেকে।
• ব্যবসা চালু এবং নতুন কার্যকরী মূলধন হিসেবে ধার নেওয়া যাবে।
• প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যে সর্বাধিক ১ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া যাবে।
• মেয়াদি ঋণ এবং কার্যকরী মূলধন হিসেবে ধার, দু’টিই নিলে সর্বাধিক ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে সুদে ২% ছাড় পাওয়া যাবে।
• রফতানির জন্য বাণিজ্য দফতরের চালু করা সুদে ছাড়ের প্রকল্পে
অংশ নিলে এই প্রকল্পে নাম লেখানো যাবে না।
• রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্য কোনও ঋণ প্রকল্প থেকে সুদে ছাড় পেলেও, এই প্রকল্পে অংশ নিতে পারবে না ছোট সংস্থাগুলি।
স্টেট ফিনান্স কর্পোরেশন
আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং ছোট ও মাঝারি শিল্পের প্রসারে মূলধন জোগানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় স্টেট ফিনান্স কর্পোরেশনগুলি। এদের কাজ—
• বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কের থেকে নেওয়া ঋণে গ্যারান্টি দেয় কর্পোরেশন।
• ঋণের সেই টাকা দিয়ে কেনা যায় জমি, অফিস, কারখানা ও যন্ত্রপাতির মতো সম্পত্তি।
• যে সমস্ত ছোট সংস্থার মূলধন ও সম্পদ ৩ কোটি টাকা (কেন্দ্রের নির্দেশে তা ৩০ কোটি পর্যন্ত হতে পারে) পর্যন্ত, তাদেরই সাহায্য করে কর্পোরেশন।
• বদলে সংস্থার শেয়ার, ডিবেঞ্চার, পণ্য নিজেদের হাতে নেয় তারা।
এ ছাড়াও আছে মুদ্রা
গত বিষয় আশয়েই মুদ্রা যোজনা নিয়ে কথা বলেছি। এখানে তাই আর সবিস্তার আলোচনায় যাব না। দেখে নেব এক নজরে এর বৈশিষ্ট্যগুলি।
• পুরো নাম প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা। ব্যবসার পুঁজি, ব্যবসা বাড়ানো, আধুনিকীকরণের জন্য ঋণ দিতে এই প্রকল্প এনেছে কেন্দ্র।
• এ ক্ষেত্রেও দেওয়া হয় কার্যকরী মূলধন এবং মেয়াদি ঋণ।
• কল-কারখানা তৈরি, আর্থিক লেনদেন, পরিষেবা ক্ষেত্র ও কৃষি ক্ষেত্রের সহযোগী শিল্পের জন্য এই ঋণ নেওয়া যায়।
• দেয় বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক, সমবায় ব্যাঙ্ক, আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, বিদেশি ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফসি) ও ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা।
• রাজ্যে স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটি ও জাতীয় স্তরে আর্থিক পরিষেবা দফতর প্রকল্পটির দেখাশোনা করে।
• সর্বাধিক ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ মেলে এই প্রকল্পে। এর তিনটি ভাগ—
শিশু: ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
কিশোর: ৫০,০০১ টাকা থেকে ৫,০০,০০০ টাকা।
তরুণ: ৫,০০,০০১ টাকা থেকে ১০,০০,০০০ টাকা।
• শিশু ও কিশোরের ক্ষেত্রে কোনও প্রসেসিং ফি লাগে না। তবে তরুণের ক্ষেত্রে ঋণের অঙ্কের ০.৫% (সঙ্গে যোগ হবে কর) ফি হিসেবে দিতে হয়।
• কিছু ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ব্যবসার খরচের পুরোটা ঋণ হিসেবে মেলে না। একাংশ সংস্থাকে দিতে হয়। তবে—
৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণে মার্জিন শূন্য। পুরো মূলধন ঋণ হিসেবে মেলে।
৫০,০০১ টাকা থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আবেদনে ১০% উদ্যোগপতিকে নিজেকে দিতে হয়। বাকি পুঁজি মেলে ঋণ হিসেবে।
• সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমসিএলআরের ভিত্তিতে সুদের হার হিসেব করা হয়।
• কার্যকরী মূলধন ও মেয়াদি ঋণ, উভয় ক্ষেত্রেই ৩-৫ বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করতে হয়। ব্যবসার ধরন বা ব্যবসা থেকে আয়ের ভিত্তিতে ছ’মাস পর্যন্ত মোরাটোরিয়ামের সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।
রয়েছে ক্ষুদ্রঋণও
ক্ষুদ্রঋণ নিয়েও কথা হয়েছে এর আগে। এখানে মূল বিষয়গুলি দিলাম।
• মাইক্রো-ফিনান্স সংস্থা, বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, সমবায় ব্যাঙ্ক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কিছু শাখা, স্মল ফিনান্স ব্যাঙ্ক, এনবিএফসি, এনবিএফসি মাইক্রো-ফিনান্স কোম্পানি এই ঋণ দিতে পারে। এ ছাড়াও দেয় সীমিতসংখ্যক অসরকারি সংস্থা (এনজিও), ক্রেডিট ইউনিয়ন ইত্যাদিও।
• ১৮ বছর হলে আবেদন করা যায়। নেওয়া যায় ৬০ বছর পর্যন্ত।
• একটি পরিবারে শুধু এক জনই এই ঋণ পেতে পারেন।
• সাধারণত ছোট ব্যবসা, কুটির শিল্প ও কৃষিকাজ সংক্রান্ত ব্যবসা শুরুর জন্য এই ঋণ মেলে। ছোট ব্যবসা বাড়ানোও যায়।
• এক জন সর্বোচ্চ দু’টি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে ঋণ নিতে পারেন।
• সাধারণত মোট ১.২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যায়।
• ঋণের মেয়াদ ১-২ বছর পর্যন্ত।
• সুদের হার স্থির হয় ঋণদানকারীর ব্যবসার অঙ্কের উপরে ভিত্তি করে।
• ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে নিয়ম আলাদা হয়।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)