প্রতীকী ছবি।
ভাবছেন প্রাণে বাঁচলেন। কিন্তু ধনে? বিশেষ করে যাঁরা অবসরপ্রাপ্ত এবং জমানো টাকার সুদে সংসার চালান তাঁদের করোনার ছোবল দেহে না পড়লেও কোভিড বিষে ট্যাঁক কিন্তু নীল হতে শুরু করেছে।
মার্চ মাসেই করোনাভাইরাসের আঁচ বিনিয়োগের উপর কমাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নীতির কারণে বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পে সুদের হার একটানে ৭০ থেকে ১৪০ দশমিক বিন্দু পর্যন্ত কমেছে। সিনিয়র সিটিজেন সেভিংস স্কিমে বা বরিষ্ঠ নাগরিক সঞ্চয় প্রকল্পে সুদের হার ৮.৬ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৭.৪ শতাংশে। কমেছে ব্যাঙ্কের অন্য নানান স্থায়ী আমানত প্রকল্পের সুদের হারও। নীতি নির্ধারকরা হয়ত পারতেন অবসরপ্রাপ্তদের কথা মাথায় রেখে বার্ধক্যের আয়ের উপর আর একটু সদয় হতে। কিন্তু সেই সৌহার্দ সাম্প্রতিক নীতিগুলিতে খুব একটা প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে না।
আবার অনেকেই বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা রেখেছেন। ওই আয় বাড়ানোর লক্ষ্যেই। সেখানেও বিপদ। এ’মাসে সুন্দরমের মতো ফান্ড হাউস তাদের হাইব্রিড স্কিমে কোনও ডিভিডেন্ড দিতে পারেনি। বাজারের অবস্থা এতটাই অনিশ্চিত।
শেয়ার বাজারে এই ডামাডোল মাপার আবার একটা সূচকও আছে। যাকে বলা হয় ভোলাটিলিটি ইনডেক্স। বাজার যত বেশি ডামাডোলে থাকে ততই উঁচুতে থাকে ভোলাটিলিটি ইন্ডেক্স। ন্যাশন্যাল স্টক এক্সচেঞ্জে গত ২ মার্চ এই সূচক ছিল ২,৫.২,০২৫ পয়েন্টে। আর ২৫ মার্চ এই অনিশ্চয়তার সূচক লাফিয়ে ছুঁয়ে ফেলে ৭,৭.৬,২৫০ পয়েন্ট। আশার কথা, এই দোলাচল ১ এপ্রিল কমে ৬,০.০,৫২৫ এ দাঁড়িয়েছে। কমেছে। কিন্তু তাও বাজারের গতির অনিশ্চয়তা কিন্তু বেশ বেশিই।
আর আমরা তো স্বাভাবিক ভাবেই শেষ বয়সে আয়ের একটা নিশ্চিত স্রোত চাইবই। সারা জীবনের সঞ্চয়ের উপর নির্ভর করেই আমরা অবসরের দিন যাপন করি। কিন্তু আমাদের দেশে সেই অর্থে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। তাই চিকিৎসার জন্য বিমার টাকাও মেটাতে হয় ওই সুদের টাকা থেকেই! আছে ওষুধ ও চিকিৎসার খরচও। আর এই করোনার বাজারে গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো বাড়বেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। আয় কমছে, বাড়ছে পেট চালানোর খরচ। এই বয়সে এসে নতুন কিছু আয়ের ব্যবস্থা করাও সবার পক্ষে সম্ভব নয়। কী করবেন এই অনিশ্চয়তার বাজারে?
যদি আপনি করোনার বাজারে অবসর নিয়ে থাকেন, তা হলে আপনার হাতে সব টাকা এখনও এসে পৌঁছনর কথা নয়। তবুও হয়ত গ্র্যাচুইটির টাকাটা ব্যাঙ্কে ঢুকেছে। আর আপনি যদি ইতিমধ্যেই অবসরের টাকা পেয়ে বিনিয়োগ করে দিয়ে থাকেন, তা হলে ভাবছেন আমানত বাঁচাতে কী করবেন! আপনাদের দু’দলের সমস্যা তাই ভিন্ন।
একটা কথা কিন্তু মাথায় রাখতেই হবে। আজকের দুনিয়ায় বাজারের অনিশ্চয়তা এড়িয়ে কিন্তু বাঁচতে পারবেন না। ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানতে টাকা রাখলেও তার আয় যে বাকি জীবন একই হারে পেতে থাকবেন তা নয়। এবং সেটা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই জেনে গিয়েছেন। তাই সুদের আয়ের একটা অংশ আপনাকে বাঁচিয়ে বিনিয়োগ করতেই হবে কোথাও। আর তা করতে গেলে কিন্তু আর একটু ঝুঁকির রাস্তায় হাঁটতেই হবে। এবং সেটা কোনও না কোনও ভাবে বাজার নির্ভর হবেই।
লকডাউনের পর বাড়ির পথে পরিযায়ী শ্রমিকরা। —ফাইল চিত্র
আরও পড়ুন: প্রণব মনমোহনদের ফোন মোদীর, চাইলেন পরামর্শ, কথা মমতার সঙ্গেও
একটা বুড়ো আঙুলের নিয়ম সঞ্চয়ের বাজারে চলে। যদি আপনার সংসার খরচ মোট আমানতের ৬ থেকে ৮ শতাংশ হয়, তা হলে আপনার টাকা দীর্ঘমেয়াদী কোনও প্রকল্পে রাখাই ভাল। কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা আছে। ধরুন আপনি ৭০ লক্ষ টাকা নিয়ে অবসর নিলেন। তা হলে ৮ শতাংশ যদি ধরি আপনার সংসার চালাতে প্রয়োজন, তা হলে আপনার বছরে প্রয়োজন হবে ৫ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা বা মাসে ৪৬ হাজার টাকার মতো। কিন্তু এই বাজারে আপনাকে ৮ শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে কে? সেই জন্যই কম, মাঝারি ও তুলনামুলক ভাবে একটু বেশি ঝুঁকির নানান প্রকল্পে বিনিয়োগ করে আমরা আয় বাড়াতে চাই। কিন্তু কোবিড সব অঙ্ক তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে।
তবে এই অঙ্কটার পিছনে যুক্তিটা কিন্তু সোজা। মানুষের প্রাথমিক চাহিদা মেটাতে যে টাকা লাগে, আপনার আমানতের উপর আয় তার থেকে যদি বেশি হয়, তা হলে আপনি আগামী দিনগুলোর জন্য বা চিকিৎসা-বিমার মতো এক লপ্তে মেটানোর মতো টাকা আলাদা করে রাখতে পারবেন। কিন্তু তা এমনি ব্যাঙ্কে ফেলা রাখাটা ঠিক নয়। ওই টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। তখনই আসে বিনিয়োগের বিভিন্ন ঝুঁকির অঙ্কের কথা আবারও।
এই নিয়ে কথা হচ্ছিল মর্নিংস্টার ইনভেস্টমেন্টের ধাবল কাপাডিয়া এবং ইকুইরাস ওয়েলথ-এর শীর্ষ কর্তা অঙ্কুর মাহেশ্বরীর সঙ্গে। এবং আমরা সহমত যে যাঁরা এই বাজারে অবসর নিয়েছেন, তাঁদের আপাতত তুলনামূলক ভাবে বেশি ঝুঁকির বাজারে না ঢুকে, সংসার চালানোর জন্য সিনিয়র সিটিজেন সঞ্চয় প্রকল্পের মতো নিশ্চিত আয়ের রাস্তায় হাঁটাই ভাল। এমনকি স্থায়ী আমানতের জন্যও কিন্তু এই বাজারে একটু সাবধানী হওয়া ভাল। ইয়েস ব্যাঙ্কের সমস্যার কথা তো জানেনই। সঞ্চয়কারীরা ভুগেছেন বেশ কিছুদিন।
আরও পড়ুন: তবলিগের ৮ পলাতক মালয়েশীয় নাগরিক ধরা পড়লেন দিল্লি বিমানবন্দরে
তাই যে সব ব্যাঙ্ক বাজারের গড় সুদের হারের থেকে বেশ কিছুটা বেশি হারে দিচ্ছে তাদের সম্বন্ধে জেনেই টাকা রাখাটা সমীচীন হবে। কারণ এদের অনেকেই তাদের ঋণের একটা বড় অংশ মাইক্রোলোনে বিনিয়োগ করেছে। এই বাজারে সেই সব ঋণের আপাত নিকট ভবিষ্যৎ কী তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। টাকা হয়ত মার যাবে না। কিন্তু আপনার মাসের রোজগার তো ওই সুদের উপরই নির্ভর করবে তাই না।এক মাসও প্রয়োজন মতো টাকা না তুলতে পারলে তো বাজার করা চাপের হয়ে যাবে! ভাবুন ইয়েস ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের ওই কয়েকটি দিনের কথা!
তাই সদ্য হাতে পাওয়া টাকা এমন কোথাও রাখুন যেখানে আমানত নিশ্চিত। আয়ও। আয় কম হলেও তা যাতে নিয়মিত থাকে তা নিশ্চিত করতে অতি সাবধানে পা ফেলাই আপাতত বাঞ্ছনীয়। এরই মধ্যে কথা বলতে শুরু করুন সঞ্চয় উপদেষ্টাদের সঙ্গে। ভাল ডাক্তারের মতোই কিন্তু একজন ভাল উপদেষ্টা আপনার আয় সুরক্ষিত রাখতে আপনাকে অনেক সাহায্য করতে পারেন যা আপনার নিজের পক্ষে করে ওঠা সম্ভব নাও হতে পারে।
যাঁরা ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ করে ফেলেছেন? কাপাডিয়া এবং মাহেশ্বরীর সঙ্গে সহমত হয়েই বলছি— হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না। হয়ত বিভিন্ন জায়গায় নিজেই বিনিয়োগ করেছেন এর তার কথা শুনে। আপনাদেরও এ বার সময় এসেছে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার। এই মুহূর্তে বাজারের যা অবস্থা তাতে একমাত্র একজন উপদেষ্টাই আপনার বর্তমান সঞ্চয়ের চরিত্র এবং আয়ের প্রয়োজন খতিয়ে দেখে বাঁচার রাস্তা বাতলাতে পারে। মনে রাখবেন এই বাজারে অসুস্থ হলে নিজের চিকিৎসা নিজে করার মতোই উপদেষ্টার পরামর্শ ছাড়া সঞ্চয়ের সিদ্ধান্ত বিপজ্জনক হতে পারে।
কেন বলছি উপদেষ্টার কথা? ধরুন আপনার টাকা এমন মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেছেন যা এই ডামাডোলের বাজারে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাতে আপনার হয়ত আমানতের পরিমাণ কমেছে। সে তো এ বাজারে প্রায় সব ফান্ডেই কমেছে। কিন্তু আপনার টাকা যে ফান্ডে আছে তার বিনিয়োগের চরিত্রের জন্যই হয়ত ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে। তাহলে তো আপনাকে টাকা সরিয়ে নিয়ে অন্য কোথাও বিনিয়োগ করতে হবে। কোথায় এবং কী ভাবে তা কিন্তু একজন সঠিক উপদেষ্টাই আপনাকে বলতে পারে।
এই টাকা সরানোরও কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। এক লপ্তে সরিয়ে নিয়ে, তা স্বল্পমেয়াদের কোনও ফান্ডে রেখে, সেখান থেকে আবার অল্প অল্প করে নির্দিষ্ট কোনও ফান্ডে বিনিয়োগ করা যেমন একটা। যাতে বাজারের দোলাচলের ফায়দা তুলতে পারেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দামে ইউনিট কিনে। ঠিক যেমন আপনি ট্যাক্স বাঁচাতে এস আই পি করেন। আবার একই সঙ্গে তোলা আমানতও যাতে আয়ের সুযোগ না-হারায় তা দেখতে সেই টাকা স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পে রেখে তার থেকে নিয়মিত বিনিয়োগ করা হয়। কিন্তু এসব নিজে না করে উপদেষ্টার পরামর্শে করাই ভাল।
অর্থাৎ হিসাব পরিষ্কার। ক) শরীর খারাপ হলে যেমন নিজের চিকিৎসা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেন, তেমনই ডামাডোলের বাজারে সঠিক উপদেষ্টা খুঁজে নিন।
খ) সদ্য অবসর নিলে দীর্ঘমেয়াদী তুলনামূলক ভাবে ঝুঁকিহীন প্রকল্পে টাকা রাখুন আপাতত।
গ) উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্দিষ্ট করুন
ঘ) ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ করে ফেললেও উপদেষ্টার পরামর্শ নিন আমানত রক্ষা করতে
ঞ) কখনই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া এই বাজারে নিজের সঞ্চয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন না। উপদেষ্টার কথা শুনুন আর তার পরেই সিদ্ধান্ত নিন পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)