হলদিয়ায় মিৎসুবিশি চ্যাটার্জিদের হাতে

মিৎসুবিশি যে হলদিয়া থেকে পাততাড়ি গোটাবে, তা জানাই ছিল। কিন্তু এ রাজ্যে জাপানি বহুজাতিক সংস্থাটির কারখানার মালিকানা যে শেষমেশ চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর হাতে যাবে, তা কিন্তু অনেকের কাছে বুধবার দুপুরের পরে খবর হয়েই এসেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫২
Share:

মিৎসুবিশি যে হলদিয়া থেকে পাততাড়ি গোটাবে, তা জানাই ছিল। কিন্তু এ রাজ্যে জাপানি বহুজাতিক সংস্থাটির কারখানার মালিকানা যে শেষমেশ চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর হাতে যাবে, তা কিন্তু অনেকের কাছে বুধবার দুপুরের পরে খবর হয়েই এসেছে। সেই হিসেবে সকলকে কিছুটা অবাক করে পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মুঠোয় যাওয়ার পথে পা বাড়াল হলদিয়ায় প্রথম বিদেশি বিনিয়োগে তৈরি ওই কারখানা।

Advertisement

বুধবার বিবৃতিতে মিৎসুবিশি কেমিক্যাল জানিয়েছে, চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর সংস্থা চ্যাটার্জি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি-নিউ ইয়র্ককে মিৎসুবিশি কেমিক্যাল কর্পোরেশন (এমসিসি) পিটিএ ইন্ডিয়ার সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করছে তারা। সেই সূত্রে হাতবদল হবে ৫৮০ কোটি শেয়ার। যার সম্ভাব্য দাম ৪.৮ কোটি ডলার (প্রায় ৩২১ কোটি টাকা)। আর সংখ্যালঘু অংশীদার হিসেবে ৬০ কোটি শেয়ার থেকে যাবে মিৎসুবিশির হাতে।

একে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের শেষে হলদিয়া পেট্রেকেমের (এইচপিএল) রাশ হাতে পাওয়ার পথে সম্প্রতি পা বাড়িয়েছে চ্যাটার্জি গোষ্ঠী। তার উপর এ বার সেখানে এমসিসি পিটিএ ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতেও দৌড় শুরু করল তারা। শুধু মালিকানা নয়, এ ক্ষেত্রে আবার তাদের প্রাপ্তি মিৎসুবিশির কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সুবিধা পাওয়ার দরজা খুলে যাওয়া। এতে চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর সামগ্রিক পেট্রো-রসায়ন ব্যবসা উপকৃত হবে বলে মনে করছেন কর্ণধার পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘মিৎসুবিশির কাছে প্রথম সারির প্রযুক্তি আছে। ফলে হলদিয়ার কারখানার চৌহদ্দি পেরিয়েও এই গাঁটছড়ার প্রভাব থাকবে।’’

Advertisement

তবে রুগ্‌ণ সংস্থা হিসেবে মিৎসুবিশি কেমিক্যালের হলদিয়ার কারখানা আপাতত বিআইএফআরে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, প্রথমে এমসিসি পিটিএ ইন্ডিয়া প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা দেনা শোধ করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। তারপরে মালিকানা বদলের পালা। ঠিক কত টাকায় এই হাতবদল হবে, তা নিয়ে মুখ খুলতে চায়নি চ্যাটার্জি গোষ্ঠী। যদিও ওই অঙ্কের একটা ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে মিৎসুবিশি কেমিক্যালের বিবৃতিতে। যেখানে হাতবদলের জন্য রাখা শেয়ারের সম্ভাব্য দাম বলা হয়েছে ৩২১ কোটি টাকা। পূর্ণেন্দুবাবুর দাবি, এই শেয়ার হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। তার জন্য প্রতিযোগিতা কমিশন-সহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক ছাড়পত্রও পেতে হবে।

হলদিয়ার কারখানায় মূলত প্যারাক্সিলিনকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে পিউরিফায়েড টেরিপথ্যালিক অ্যাসিড (পিটিএ) তৈরি করত মিৎসুবিশি কেমিক্যাল। যা প্রধানত ব্যবহার হয় পলিয়েস্টার কাপড় এবং প্লাস্টিক বোতল তৈরিতে। কিন্তু ২০০৮ সালে বিশ্বজোড়া মন্দা শুরুর পর থেকেই তা সমস্যার মুখে পড়ে। একে বিশ্ব বাজারে চাহিদায় মন্দা, তার উপরে প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি পিটিএ তৈরি শুরু করে চিন। এই জোড়া সমস্যার কারণে বছর পাঁচেক ধরেই সংস্থা লাভের মুখ দেখছিল না। সঙ্গে দোসর হিসেবে ছিল শ্রমিক অসন্তোষ, রাজ্যের প্রবেশ কর বসানোর মতো সমস্যা। সব মিলিয়ে, নিট সম্পদ নেমে গিয়েছে শূন্যের নীচে। ২০১৩ সালে জোটে রুগ্ণ সংস্থার তকমা। যেতে হয়েছে বিএফআইআরে। তারপরেই মালিকানা হস্তান্তরের এই সিদ্ধান্ত।

শুধু ভারতে নয়, চিনেও চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি হওয়ার কারণে পিটিএ ব্যবসা গোটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিৎসুবিশি কেমিক্যাল। রেখে দিচ্ছে কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ব্যবসা। তাদের দাবি, কোরিয়ায় সংস্থা পুনর্গঠনের ফলে লোকসানের বোঝা কমেছে। আর ইন্দোনেশিয়ার নিয়ন্ত্রিত বাজারে চিনা পণ্যের সঙ্গে পাল্লা তত তীব্র নয়।

উল্টো দিকে সংশ্লিষ্ট শিল্পমহলের দাবি, মিৎসুবিশি কেমিক্যালের হলদিয়া কারখানা হাতে পাওয়ায় আরও বেশি সংখ্যক পেট্রোপণ্য বাজারে আনতে পারবে চ্যাটার্জিরা। হলদিয়া পেট্রোকেম হাতে আসার পরে আরও শক্ত হবে তাদের পায়ের তলার জমি।

হলদিয়া পেট্রোকেমের কাঁচামাল ন্যাপথা। এই ন্যাপথার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পলিপ্রপিলিন ও পলিইথিলিন উৎপাদনে কাজে লাগানো হয়। দিনে প্রায় ৩,০০০ টন পলিপ্রপিলিন ও পলিইথিলিন তৈরি হয় সেখানে। প্লাস্টিকের জিনিসপত্র তৈরি করতে এই দু’টি পণ্য জরুরি। বাকি ন্যাপথা মোটর স্পিরিট, বেঞ্জিন, বুটা়ডিন-সহ নানা পেট্রোপণ্য তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, হলদিয়া পেট্রোকেম এবং মিৎসুবিশি কেমিক্যালের কারখানা হাতে এলে, দু’ধরনের কাঁচামাল থেকে ভিন্ন রকম পণ্য বিক্রির সুবিধা পেয়ে বাজার দখলের পথে পা বাড়াতে পারবে চ্যাটার্জি গোষ্ঠী। সে দিক থেকে দেখতে গেলে রাজ্যে বাম জমানার শিল্পায়নের দুই ‘শো-কেস’ প্রকল্পই যাচ্ছে পূর্ণেন্দুবাবুর ঝুলিতে।

কিন্তু মিৎসুবিশি যে ব্যবসায় লাভের কল্কে পায়নি, সেখানে চ্যাটার্জি গোষ্ঠী টাকা ঢালছে কোন যুক্তিতে? সংশ্লিষ্ট শিল্পমহলের মতে, দু’টি কারণে এখন মিৎসুবিশি কেমিক্যালের পিটিএ কারখানা চালানো চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর পক্ষে সুবিধাজনক হবে। প্রথমত, সংস্থা ঋণমুক্ত হয়ে যাওয়ায় সুদ গুনতে হবে না। ফলে উৎপাদনের খরচ কমবে। দ্বিতীয়ত, অ্যান্টি-ডাম্পিং আইন কার্যকর হওয়ায় চিনা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যুঝতে সুবিধা হবে।

উল্লেখ্য, মিত্সুবিশি কেমিক্যালের হাত ধরেই হলদিয়ায় প্রথম বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। ২০০০ সালে তৈরি হয় প্রথম কারখানা। এর পরে সংস্থার সম্প্রসারণ পরিকল্পনাতেও জায়গা করে নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। ২০১০ সালে চালু হয় দ্বিতীয় কারখানা। দু’ দফায় প্রায় ৩,৫০০ কোটি টাকা ঢেলেছে এই জাপানি বহুজাতিক। কর্মী সংখ্যা ১,১০০।

বুধবার মিৎসুবিশি কেমিক্যাল কর্পের হোল্ডিং (মূল) সংস্থা মিৎসুবিশি কেমিক্যাল হোল্ডিংস কর্পোরেশন টোকিওয় পরিচালন পর্ষদের বৈঠক ডাকে। সেই বৈঠকেই এমসিসি পিটিএ ইন্ডিয়ার সিংহভাগ শেয়ার চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করে দেওয়ার বিষয়ে সিলমোহর দেওয়া হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement