নিখাদ অর্থনীতির সংজ্ঞা মানলে মন্দা আসেনি ঠিকই। কিন্তু আকাশে যে তার আশঙ্কার মেঘ জমছে, সেটা স্পষ্ট খোদ সরকারি পরিসংখ্যানেই। যা তুলে ধরে আজ বিরোধীদের অভিযোগ, সব দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে আছে কেন্দ্র। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও সঙ্কটের কথা স্বীকার করতে চাইছে না।
অর্থনীতিতে তীব্র আর্থিক সঙ্কট যে দানা বাঁধছে, ইতিমধ্যেই তার ইঙ্গিত দিয়েছে বাজারে ঢিমে হওয়া বিক্রিবাটা। তার উপর বুধবার সরকারি পরিসংখ্যানেই প্রকাশ, চলতি অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসে কর খাতে আয় বৃদ্ধি গত এক দশকে সর্বনিম্ন, মাত্র ১.৩৬%। যেখানে মোদী জমানার গত চার বছরে তা ছিল ১৫ থেকে ৩০ শতাংশের ঘরে। জুনে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বৃদ্ধিও ঠেকেছে মাত্র ০.২ শতাংশে। অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন, এ সব যদি সম্ভাব্য মন্দার লক্ষণ না হয়, তবে আর কী হলে সরকার তা স্বীকার করবে?
টুইটে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে নিশানা করে কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীর হুঁশিয়ারি, অর্থনীতি লাইনচ্যুত। মন্দার ট্রেন পূর্ণ গতিতে ছুটে আসছে।
পরিস্থিতি নিয়ে এই প্রথম মুখ খুলতে শুরু করেছে শিল্পও। এ দিনই পরিকাঠামো সংস্থা এল অ্যান্ড টি-র নন-এগ্জিকিউটিভ চেয়ারম্যান এ এম নায়েকের দাবি, সরকার যা-ই বলুক না কেন, এ বছর বৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশের বেশি হবে না। তিনি বলেন, ‘‘অর্থনীতির হাল ফেরাতে মুখ্যমন্ত্রী (গুজরাতের) মোদীর মতো কাজ করুন প্রধানমন্ত্রী মোদী।’’ লগ্নি প্রস্তাবে ছাড়পত্র দেওয়ার মতো বিষয়ে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আর্জিও জানান তিনি।
আশঙ্কার মেঘ
• এপ্রিল থেকে জুন— এই তিন মাসে কর আদায় বেড়েছে ১.৩৬%। এক দশকে সবচেয়ে কম।
• জুনে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বৃদ্ধি (০.২%) তলানিতে।
• সার, যন্ত্রাংশ ইত্যাদির আমদানি কমেছে, যা পড়তি চাহিদার লক্ষণ।
• বেশ কয়েক মাস ধরে নাগাড়ে কমছে গাড়ি বিক্রি।
• একটি বাদে লোকসানে ডুবেছে সব মোবাইল পরিষেবা সংস্থা।
• কমছে রেলের পণ্য পরিবহণ।
• গ্রামের আয় বাড়ছে শামুক গতিতে। এতটাই ধীরে যে, বিপদের সঙ্কেত তাতে।
• পর্যাপ্ত সংখ্যায় কাজ তৈরির লক্ষণ নেই। বরং ইতিমধ্যেই ফাঁস হওয়া সরকারি সমীক্ষায় প্রকাশ, বেকারত্বের হার গত সাড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ।
• ধাক্কা খেয়েছে সার্বিক বৃদ্ধিও। চিনকে টেক্কা দিলেও, তা রয়েছে ৭ শতাংশের আশেপাশে।
• খোদ প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টারই দাবি চাহিদায় ভাটা। দেখা নেই লগ্নিরও।
অর্থনীতিবিদদের মতে, কর খাতে অর্থমন্ত্রী বিপুল আয়ের লক্ষ্য বেঁধেছেন। কিন্তু প্রথম তিন মাসে সেই আয় বৃদ্ধি দেড় শতাংশের কম হলে, বাকি ৯ মাসে তা বাড়াতে হবে প্রায় ২২% হারে। সেটা কার্যত অসম্ভব। তাঁদের প্রশ্ন, এই অবস্থায় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে কী করে?
অর্থ মন্ত্রকের কর্তারাও মানছেন, অর্থনীতির বেশ কিছু লক্ষণ নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। যেমন, আমদানি, গাড়ি বিক্রি, বিমান যাত্রা কমা। একটি বাদে সব মোবাইল সংস্থার লোকসানে ডোবা। গ্রামের আয় শ্লথ হওয়া। অনেকের মতে মূল্যবৃদ্ধি কম থাকা নিয়ে সরকার বড়াই করলেও, তা থেকে স্পষ্ট চাহিদা ঝিমিয়ে।
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘‘মানুষের জীবিকা সঙ্কটে পড়েছে। কিন্তু শাসক দল সাম্প্রদায়িক বিভাজন করে নজর ঘোরাতে ব্যস্ত।’’
বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী-সহ সরকারের মন্ত্রীরা ঢাক পেটাতে শুরু করেন, ২০১৮-১৯ সালে রেকর্ড ৬,৪৩৭ কোটি ডলার বিদেশি লগ্নি এসেছিল বলে। অথচ মন্দার লক্ষণ প্রসঙ্গে তাঁরা নীরব। ইয়েচুরির তোপ, ‘‘চাষি, ছোট ব্যবসায়ী, উদ্যোগপতি—সমাজের সকলের জন্য দুর্দশা ডেকে আনাটাই মনে হচ্ছে ২০১৪ থেকে মোদী সরকারের আর্থিক নীতি। অথচ সরকার তার দায় নিতে নারাজ।’’