সিঙ্গুরের সেই জমি। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যে শিল্পায়নের খাতিরে পথ বদলে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের দাগ মোছার চেষ্টা করেছিলেন প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর চেষ্টাতেই দেশ তথা আন্তর্জাতিক স্তরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল রাজ্যের ‘শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি’। কিন্তু তাঁরই সময়ে আবার সেই ভাবমূর্তিকে ভেঙে দিয়েছিল টাটাদের সিঙ্গুর ত্যাগ। সেই অধ্যায়ের পরে টাটা-কারখানার ছ’গুণ বেশি জমি কাজে লাগিয়েও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রাজ্যমুখী করতে পারেনি তৎকালীন বাম সরকার। হুগলিতে জাতীয় সড়কের পাশে ধুলোয় মিশে যাওয়া টাটা মোটরসের প্রস্তাবিত গাড়ি কারখানার বিপুল জমিতে ফেরেনি শিল্পও। রাজ্যের রাজনৈতিক অলিন্দে পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গকে তেমন মূল্যবান লগ্নির প্রত্যাশী হয়ে থাকতে হচ্ছে এখনও। বিশ্লেষকদের বক্তব্য, ভাবমূর্তি গড়া-ভাঙার সেই সন্ধিক্ষণে থাকা বুদ্ধবাবু প্রয়াত হলেও, থেকেই যাবে মৌলিক প্রশ্নটি—‘ক্ষত’ মেরামত হবে তো?
টাটা প্রকল্পের প্রায় ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক এবং রাজনৈতিক উত্তাপ কমানো যায়নি। বিফল প্রকল্পে ধাক্কা খায় বুদ্ধবাবুর রাজ্যকে শিল্পবান্ধব করে তোলার চেষ্টা। পর্যবেক্ষকদের অনেকে জানাচ্ছেন, তখনকার জমি-আন্দোলনের যে ‘সুফল’ ভোটবাক্সে পেয়েছিল এখনকার শাসকদল তৃণমূল, রাজনৈতিক প্রয়োজনেই সেই অবস্থান বদল করা আর সম্ভব হয়নি। ফলে শিল্পমহলে যায় ভিন্ন বার্তা। মুখ ফেরায় লগ্নি। সংশ্লিষ্ট মহলের আক্ষেপ, গাড়ি-সহ উৎপাদন শিল্পে দেশের অন্যত্র লগ্নি হলেও, পশ্চিমবঙ্গ থেকে গিয়েছে বড় লগ্নিকারীদের নজরের বাইরে।
প্রবীণ আমলারা মনে করাচ্ছেন, সিঙ্গুর পর্বের পরে পানাগড়, বিদ্যাসাগর, রঘুনাথপুর, ঋষি বঙ্কিম শিল্পতালুক এবং অন্ডালে রাজ্যের একমাত্র বিমাননগরী মিলিয়ে প্রায় ৬০০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে বুদ্ধবাবুর সরকার। তার পরেও বড় মাপের শিল্প রাজ্যের থেকে দূরে সরে থেকেছে। বর্তমান সরকারও জমি-ব্যাঙ্ক তৈরির দাবি করেছে। সরকারি বিভিন্ন জমি শিল্প এবং শিল্পতালুকের জন্য বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চালু করেছে লিজ়ে দেওয়া জমিতে মালিকানা দেওয়ার নীতি। তবু উল্লেখযোগ্য শিল্পের বিনিয়োগ এখনও অধরাই। পর্যবেক্ষকদের একাংশের দাবি, বর্তমান সরকার রাজ্যে টাটাদের বিকল্প শিল্প আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি শুধুমাত্র ভাবমূর্তির কারণে। তা ছাড়া বড় মাপের শিল্পে প্রয়োজন একলপ্তে বিপুল পরিমাণ জমি। সেটা রাজ্যের জমি নীতি অনুযায়ী কতটা দেওয়া সম্ভব, বহাল প্রশ্ন।
রাজ্যের আধিকারিকদের অনেকের দাবি, গত বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলনগুলি (বিজিবিএস) মিলিয়ে বেশ কয়েক লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। দেওয়া হয়েছে সহজে ব্যবসার পরিবেশ তৈরির ধারণা, শিল্পমহলের সমস্যা সমাধানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রশাসনিক কমিটি, জমি ব্যাঙ্ক, নিরাপত্তা, সরকারি সহযোগিতা-সহ অনেক সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, প্রস্তাবের কতটা কার্যকর হয়েছে, তা এখনও অজানা। এ নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ তৈরির কাজ শুরু করেছিল নবান্ন। কিন্তু তা এখনও প্রকাশিত হয়নি। তাই শিল্পের জন্য সত্যি কতটা ‘উর্বর’ ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে এ রাজ্য, সে ব্যাপারে সংশয় থাকছে। আর সংশয়ের কেন্দ্রে সেই ভাবমূর্তিই। যা গড়ার পথে এগিয়েও ভেঙে যাওয়া আটকাতে পারেননি বুদ্ধবাবু।