টাকা জমা দেওয়া বা তোলার জন্য ব্যাঙ্কে দীর্ঘ লাইনের যুগ কার্যত শেষ। নেট লেনদেনের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে এখন করে ফেলা যায় সেই সব কাজ। অর্ডার করা যায় পণ্য বা পরিষেবা। হাতে নেট ব্যাঙ্কিং, মোবাইল ব্যাঙ্কিং, আইএমপিএস, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ইউপিআই, মোবাইল ওয়ালেটের মতো হরেক অস্ত্র তো আছেই। অপেক্ষা শুধু কিছুক্ষণ সময় বার করে প্রযুক্তিগুলি শিখে নেওয়ার।
নেটে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য যদি ঘাঁটেন, তা হলেই দেখতে পাবেন কত দ্রুত বাড়ছে অনলাইন লেনদেন। যাঁরা এত দিন এই ধরনের প্রযুক্তির থেকে দূরে থাকাটাই পছন্দ করে এসেছেন, তাঁদেরও একটা অংশ করোনাকালে অনলাইন লেনদেন শুরু করেছেন। বাড়িতে বসে পাওয়া যাচ্ছে পরিষেবা। চলে আসছে আর্ডার করা পণ্য। বজায় থাকছে পারস্পরিক দূরত্ব।
তবে সাবধান!
যে কোনও প্রযুক্তির সঙ্গেই ঝুঁকি যুক্ত থাকে সব সময়ে। নেট লেনদেনও ব্যতিক্রম নয়। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি, সেই ঝুঁকি কমানোর দিকে ঠিক মতো নজর না-দিলে বিপদ হতে পারে যে কোনও সময়ে। সাইবার প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে হারাতে হতে পারে মোটা অর্থ (সারণিতে অনলাইন লেনদেনের জনপ্রিয়তা এবং প্রতারণা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হল)। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির তরফে এই বিষয়ে প্রচার করা হয় না, তা কিন্তু নয়। তবু এখনও পর্যন্ত প্রত্যাশামাফিক সচেতনতা বাড়েনি। ফলে সুবিধা হচ্ছে প্রতারকদের। ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সে কারণেই একসঙ্গে সংক্ষেপে একগুচ্ছে পরামর্শ। যেগুলি মেনে চললে সাইবার প্রতারণার আশঙ্কা অনেকটা কমতে পারে।
ওটিপি শুধু আপনার
ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড বা ওটিপি কী? আপনার ডিজিটাল লেনদেনের অতিরিক্ত সুরক্ষা দেওয়াল। হ্যাকার যদি কোনও ভাবে লেনদেনের আইডি-তে ঢুকেও পড়ে, তা হলেও যাতে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরাতে না-পারে, সে জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ফোন বা ই-মেলে ওটিপি পাঠানো হয়। যেটা জানবেন শুধু আপনি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট জায়গায় তা বসালেই লেনদেনের দরজা খুলবে ব্যাঙ্ক।
কিন্তু এই ওটিপি জানার জন্যও ফাঁদ পেতে বসে রয়েছে দুষ্কৃতীদের চক্র। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের বা আয়কর দফতরের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে ওটিপি জানতে চায় তারা। তাই তা দ্বিতীয় কাউকে দেবেন না। ঠিক যেমন কাউকে জানান না এটিএমের পিন, নেট ব্যাঙ্কিংয়ের পাসওয়ার্ড।
একটি যন্ত্র থেকেই
চেষ্টা করুন আপনার ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মাধ্যমেই নেট লেনদেন করতে। সে আর্থিক বা টিকিট কাটা হোক, অথবা হোক ই-কমার্স সাইট থেকে পণ্য কেনা। পারতপক্ষে অন্য কোনও যন্ত্র ব্যবহার করবেন না। লেনদেনে পাবলিক ওয়াইফাই নেটওয়ার্কও এড়িয়ে চলুন। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত তথ্য অন্য কারও হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সতর্ক থাকুন
বাড়িতে বসেই রোজগারের সুযোগ। লটারিতে জিতেছেন কোটি টাকা। অমুককে সাহায্য করুন— মাঝেমধ্যেই এই সমস্ত ই-মেল দেখতে পাবেন। কিন্তু সাবধান। এর বেশিরভাগই কিন্তু ফাঁদ। দেখে মনে হতে পারে বিশ্বাসযোগ্য জায়গা থেকেই বুঝি এসেছে। কিন্তু ক্লিক করলেই স্পাইওয়্যার বা ম্যালওয়্যার ইনস্টল হয়ে যেতে পারে মেশিনে। নেটব্যাঙ্কিং পাসওয়ার্ড, কার্ডের তথ্য-সহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য চলে যেতে পারে হ্যাকারদের হাতে। একই ঘটনা ঘটতে পারে অসুরক্ষিত ওয়েবসাইট থেকে কিছু ডাউনলোড করলেও। তাই সন্দেহজনক কোনও ই-মেল বা অসুরক্ষিত ওয়েবসাইটে ক্লিক করবেন না। সাইটের ইউআরএল ‘https://’ হলে ঠিক আছে। যেগুলি ‘http://’ দিয়ে শুরু, সেগুলি না-খোলাই ভাল।
শক্তিশালী পাসওয়ার্ড
একাধিক কার্ড, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট, ই-মেল, গুচ্ছের অ্যাপ। পিন এবং পাসওয়ার্ডের সংখ্যাও একগাদা। তাই মনে রাখাও কঠিন। এই সমস্যাকে কিছুটা হাল্কা করতে গিয়ে আমরা অনেকে যা করি সেগুলোও কিন্তু যথেষ্ট বিপজ্জনক। সহজ এবং ছোট পাসওয়ার্ড, কখনও জন্ম তারিখ বা বিয়ের তারিখ, কখনও আবার একাধিক সাইটের জন্য একই বা সামঞ্জস্যপূর্ণ পাসওয়ার্ড। এ ভাবে পাসওয়ার্ড তৈরি করা কিন্তু যথেষ্ট ঝুঁকির। হ্যাকার যদি একটি প্রোফাইলে ঢুকতে সফল হয়, তা হলে অন্যান্য প্রোফাইলে ঢুকে পড়ারও আশঙ্কা থাকে। তাই শক্তিশালী এবং আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। চেষ্টা করুন একটি পাসওয়ার্ডে বিভিন্ন ধরনের ক্যারেকটার রাখতে। নির্দিষ্ট সময় পরপর তা বদল করুন।
অ্যান্টিভাইরাস অবশ্যই
ভাল অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার সাইবার প্রতারণার আশঙ্কা অনেকটাই কমায়। তাই অ্যান্টিভাইরাস আপডেট করুন নিয়মিত। অনেকে বাজে খরচ ভেবে সেটা করেন না। এটা কিন্তু ভুল। পাশাপাশি, কম্পিউটারের ব্রাউজ়ার এবং স্মার্টফোন মাঝেমধ্যেই ‘আপডেট রিকোয়েস্ট’ পাঠায়। সেই অনুযায়ী আপডেট করে নেওয়া উচিত।
মোবাইল অ্যালার্ড
ব্যাঙ্কের থেকে সব সময়ে মোবাইল অ্যালার্ট পরিষেবা নিন। তা হলে প্রতিটি লেনদেনের এসএমএস মোবাইলে আসবে। ভুয়ো লেনদেন হলে সেটাও জানতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে সময় নষ্ট না-করে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করুন। ব্লক করুন কার্ড। যাতে ওই অ্যাকাউন্টে দ্বিতীয় বার আর একই ধরনের ঘটনা না-ঘটে।
রিসিভ ও ট্রান্সফার
ইউপিআই প্রযুক্তিতে টাকা পাঠানো বা গ্রহণ করা যায় মুহূর্তের মধ্যে। কিন্তু এখানেও রয়েছে প্রতারণার ফাঁদ। বিশেষ করে যদি কেউ নেটে পণ্য বিক্রি করেন, তা হলে পেমেন্ট নেওয়ার সময়ে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতারকেরা ‘ট্রান্সফার মানি’ রিকোয়েস্টের বদলে ‘রিসিভ মানি’ রিকোয়েন্ট পাঠায়। সজাগ থেকে ধীরেসুস্থে লেনদেন না-করলে কিন্তু এই ফাঁদে পড়ে টাকা খোয়াতে হতে পারে। তাই এই ধরনের লেনদেনের আগে ভাল ভাবে জেনে নিন ‘ট্রান্সফার মানি’ এবং ‘রিসিভ মানি’র পার্থক্য।
সতর্কতা অ্যাপেও
কোনও ইউপিআই অ্যাপের কাস্টমার কেয়ারে ফোন করার আগে নিশ্চিত হোন, আপনি ঠিক নম্বরে ফোন করছেন তো? একই সতর্কতা প্রয়োজন যে কোনও নেট পরিষেবা সংক্রান্ত অ্যাপ ডাউনলোডের সময়েও। কারণ, বহু ক্ষেত্রেই মানুষ ভুল নম্বরে ফোন করে প্রতারণার জালে জড়িয়ে পড়েন। সেই প্রতারকদের পরামর্শ মতো এমন কোনও অ্যাপ হয়তো মোবাইলে ডাউনলোড করেন, যা সেই মোবাইলে থাকা ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড, সিভিভি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর, ইউপিআই পিন-সহ সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। কোনও ক্ষেত্রে পরিচিত ও বিখ্যাত সংস্থার লোগোও দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের অ্যাপে ব্যবহার করে সাইবার দুষ্কৃতীরা। ফলে কোনও নম্বরে ফোন করা বা অ্যাপ ডাউনলোড করার আগে নিশ্চিত হতে হবে।
তথ্য দেওয়া
কোনও আত্মীয় বা বন্ধুকে আর্থিক লেনদেনে সাহায্য করার জন্য অনেক সময়েই আমরা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বা ই-মেলের মাধ্যমে কার্ডের তথ্য পাঠাই। যেটা খুবই ঝুঁকির। এতে আত্মীয়ের কাছে দ্রুত তথ্য পৌঁছবে ঠিকই, কিন্তু হ্যাকারের হাতেও তা চলে যাওয়ার আশঙ্কা কম নয়। ফোনে তথ্য দেওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কম। তবে সেটাও ১০০% সুরক্ষিত নয়। সবচেয়ে নিরাপদ যদি নিজেই সেই আত্মীয়ের হয়ে পেমেন্ট করে দিতে পারেন।
তথ্য সেভ নয়
নেটে যাঁরা নিয়মিত লেনদেন করেন বা বিল মেটান, তাঁদের অনেকেরই অভ্যাস রয়েছে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট ও অ্যাপে কার্ডের তথ্য সেভ করে রাখার। যাতে প্রত্যেক বার সবিস্তার তথ্য দিতে না-হয়। এ ক্ষেত্রেও কিন্তু আপনার প্রোফাইলে ঢুকে কার্ডের তথ্য হাতিয়ে নেওয়া অসম্ভব কাজ নয় হ্যাকারদের পক্ষে। বরং আমি বলব, পেমেন্টের সময়ে প্রত্যেক বার কার্ডের বিস্তারিত তথ্য সাইটে দিন। সময় বেশি লাগবে। কিন্তু বাড়বে তথ্যের নিরাপত্তা।
পণ্য কেনার সময়
অনলাইনে জিনিসপত্র কেনার অভ্যাস মানুষের যত বাড়ছে, ই-মেলের ইনবক্স বা সোশ্যাল মিডিয়া ততই ভরে উঠছে লোভনীয় সব ছাড়ের অফারে। সতর্ক থাকতে হবে এ ক্ষেত্রেও। কারণ, হ্যাকাররা ফাঁদ পেতে রয়েছে এখানেও। তাই অচেনা ওয়েবসাইট থেকে কিছু কেনার আগে ভাল করে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। বিক্রেতা সম্পর্কে নিশ্চিত না-হলে পণ্য এলেই দাম মেটানো ভাল। তাতে যদি বেশি খরচও হয়, তা হলেও ঝুঁকি নেবেন না।
দেখে নিন স্টেটমেন্ট
ক্রেডিট কার্ডের বিল মেটানোর সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা স্টেটমেন্ট মিলিয়ে দেখি না। জানি, সারা মাসের ছোট-বড় সমস্ত লেনদেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো কঠিন। কিন্তু একটু কষ্ট করে হলেও সেটাই করা উচিত। হ্যাকারের হাতে কোনও ভাবে ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চলে এলে প্রথমে তারা খুব ছোট ছোট অঙ্কের লেনদেন শুরু করে। এটা ভেবেই ছোট অঙ্কের লেনদেন করে যে, আপনি সম্ভবত তা খেয়াল করবেন না। যদি তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়, তা হলে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে বড় অঙ্কের প্রতারণার চেষ্টা করতে পারে।
তাই দেখে নিন সমস্ত লেনদেন ঠিক কি না। কোনও গরমিল দেখলে ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করুন, সে যত ছোট লেনদেনই হোক না-কেন।
লেখক ব্যাঙ্কবাজার ডট কমের সিইও
(মতামত ব্যক্তিগত)