এবার ভ্রমণের গন্তব্যস্থল হিসেবে ঘরের পাশেই বিদেশের দিকে তাকালে কেমন হয়? নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, শীতকালে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশের কয়েকটা অসামান্য গন্তব্যস্থল সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১. কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত - পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। সারা বছরই দর্শনার্থীর ভিড়। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ অখণ্ড সৈকতে বসে সামনের শুধু উত্তাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায় সারাদিন। পৌঁছনোর ঠিকানা - এই স্থানে ঢাকা থেকে সড়কপথে বাসে পৌঁছনো যায়। সরাসরি বিমানে কক্সবাজার এয়ারপোর্টে নামা যায়। তবে ট্রেনে গেলে চট্রগ্রাম পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে বাসে চেপে কক্সবাজার যেতে হবে। চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজ কিংবা দামপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে কক্সবাজারের বাস ছাড়ে।
২. সেন্ট মার্টিন দ্বীপ - বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। স্থানীয় মানুষজনের কাছে নারকেল জিঞ্জিরা নামে বেশি জনপ্রিয়। মাত্র ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই ক্ষুদ্র দ্বীপের অবস্থান কক্সবাজার জেলা সদর থেকে ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণে। নিঃসীম নীল দিগন্তের কোণে ফেনিল সমুদ্রের মিশে যাওয়া, সারি সারি নারকেল গাছ ঘেরা দ্বীপের সহজ-সরল জীবন ভ্রমণপিপাসু মানুষকে কাছে টানে অমোঘ আকর্ষণে! পৌঁছনোর ঠিকানা - সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যেতে ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি টেকনাফ্ গিয়ে সেখান থেকে জাহাজে চড়ে পৌঁছনো সব চেয়ে সুবিধাজনক। জাহাজ সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন চলাচল করে। প্রতি দিন সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করে জাহাজ। ফেরত আসে বিকাল ৩টা থেকে সাড়ে ৩টের মধ্যে।
৩. কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, পটুয়াখালি - প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমুদ্র সৈকতের ঠিক-ঠিক অবস্থান পটুয়াখালি জেলার কলাপাড়া থানার অন্তর্গত লতাচাপলি ইউনিয়নে। এখানকার নিরিবিলি বেলাভূমি এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল কুয়াকাটাকে স্বতন্ত্র করেছে। পৌঁছনোর ঠিকানা - ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যাওয়ার উপায় নদী ও সড়কপথ। ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে পটুয়াখালি বা বরিশাল হয়ে বাকি পথ বাসে কুয়াকাটা। বর্তমানে পদ্মা সেতুর কারণে মাত্র ৫ ঘণ্টায় বাসে পৌঁছনো যায় কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত।
৪. সুন্দরবন, খুলনা - বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর সুন্দর সুন্দরবন। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে 'ইউনেস্কো' স্বীকৃতি দিয়েছে এই বনাঞ্চলকে। পৌঁছনোর ঠিকানা - খুলনার সুন্দরবন যেতে হলে বন অধিদফতরে নির্ধারিত 'ফি' দিয়ে অনুমতিপত্র এবং সঙ্গে অবশ্যই নিরাপত্তারক্ষী নিতে হয়। এখানকার সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার একমাত্র মাধ্যম লঞ্চ ও ছোট জাহাজ। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন সড়ক পথেই বাংলাদেশের সুন্দরবন ভ্রমণে যেতে পারছেন মানুষ।
৫. লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মৌলভীবাজার - ১ হাজার ২৫০ হেক্টর আয়তনের সুবিশাল এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অবস্থান ওপার বাংলার মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের আংশিক নিয়ে। 'ট্রপিকাল রেইন ফরেস্ট' হিসেবে খ্যাত এই জাতীয় উদ্যান বিভিন্ন বিরল জীবের বৈচিত্র্যে ভরপুর। সবমিলিয়ে ৪৬০ রকম প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ, ২০ রকম প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৬ রকম প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২৪০ রকম প্রজাতির পাখির বাসস্থান এখানে। বিশেষ করে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের সবচেয়ে বড় বিচরণ এলাকা হিসেবে এই অরণ্যের সুখ্যাতি রয়েছে। বনের ভেতরে আছে তিন-তিনটে ট্রেইল। যে গুলি ট্রেকিং করার সময় কাছ থেকে দেখা যায় অরণ্যের অপার সৌন্দর্যকে। পৌঁছনোর ঠিকানা - ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে করে শ্রীমঙ্গল পৌঁছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ করা যায়।
৬. কুতুবদিয়া দ্বীপ, কক্সবাজার - বাংলাদেশে বাতিঘর দেখতে হলে সটান পৌঁছে যান কক্সবাজার জেলার ছোট উপজেলা কুতুবদিয়ার অন্তর্গত এই দ্বীপে। এখানকার সুপ্রাচীন বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ যেন এখনও অতীত দিনের গল্প বলে। ২১৬ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট এই দ্বীপে আছে নির্জন সমুদ্র সৈকত এবং কুতুব আউলিয়ার মাজার। পৌঁছনোর ঠিকানা - কুতুবদিয়া দ্বীপ ভ্রমণের জন্য কক্সবাজার থেকে প্রথমে চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড আসতে হবে। সেখান থেকে জলপথে মগনামা ঘাট পৌঁছে ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে কুতুবদিয়া চ্যানেলে নামতে হবে। আর এই চ্যানেলই পৌঁছে দেবে কুতুবদিয়া দ্বীপে।
৭. মনপুরা দ্বীপ, ভোলা - হরিণ দেখার জন্য পর্যটকদের প্রিয় স্থান মনপুরা দ্বীপ। সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখার জন্যও। মেঘনা নদীতে ৫০০ মিটার পর্যন্ত স্থাপন করা মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশনে দিনভর পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। এই দ্বীপ ভ্রমণে এসে দর্শনার্থীরা চৌধুরী প্রজেক্টের মাছের ভেড়ি আর সারি সারি নারকেল গাছের বিস্তৃত এলাকাতেও বেড়িয়ে আসেন। দ্বীপের সবুজের মাঝে ক্যাম্পিংয়ের জন্যও দুর্ধর্ষ জায়গা মনপুরা দ্বীপ। পৌঁছনোর ঠিকানা - মনপুরা দ্বীপে যাওয়ার জন্য ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠতে হবে। এছাড়া ঢাকা থেকে সড়কপথে ভোলা হয়ে তজুমদ্দিন ঘাটে এসে সেখান থেকে মনপুরা দ্বীপ যাওয়া যায়।
৮. নিঝুম দ্বীপ, নোয়াখালি - বঙ্গোপসাগর ঘেরা ছোট্ট এই দ্বীপের আয়তন প্রায় ১৪ হাজার একর। নোয়াখালির হাতিয়া অঞ্চলের নিঝুম দ্বীপ শীতকালে ভরে ওঠে পরিযায়ী পাখিতে। এখানকার সবচেয়ে সেরা আকর্ষণ হচ্ছে চিত্রা হরিণ। অন্য আর কোথাও এক সঙ্গে এত চিত্রা হরিণের দেখা পাওয়া যায় না। পৌঁছনোর ঠিকানা - নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে প্রথমে পৌঁছতে হবে চেয়ারম্যান ঘাটে। সেখানে থেকে হাতিয়া। তারপর হাতিয়ার অন্য প্রান্তে মোক্তারিয়া ঘাটে। সেখান থেকে ট্রলারে চড়ে নিঝুম দ্বীপ। তবে সেরা উপায় হচ্ছে, ঢাকার সদরঘাট থেকে হাতিয়ার লঞ্চে উঠে পড়া। হাতিয়ায় পৌঁছে তমুরদ্দী ঘাট থেকে পাওয়া যাবে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার ট্রলার।
৯. রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য, হবিগঞ্জ - বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা অবস্থিত সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায়। ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এই বনভূমিকে বন্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৮২ সালে। এখানে প্রায় ৬৩৮ ধরনের প্রজাতির উদ্ভিদ, ৬২ ধরনের প্রজাতির প্রাণী এবং ১৬৭ ধরনের প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়। এই অভয়ারণ্যে আছে অপরূপ সুন্দর তিনটে ট্রেইল, যেখানে ট্রেকিংয়ের সময় খুব কাছ থেকে জীবজন্তু দেখা যায়। এ ছাড়া গোটা বনকে এক নজরে দেখার জন্য আছে সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা 'ওয়াচ টাওয়ার'। পৌঁছনোর ঠিকানা - রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে যেতে ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছে টমটম্ চড়ে যেতে হবে নতুন ব্রিজ। সেখান থেকে জলপথে চুনারুঘাট মধ্যবাজার পৌঁছে আরেকটা জলযানে চেপে কালেঙ্গাবাজার নামতে হবে। তারপর ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই অভয়ারণ্যের প্রধান ফটক।
১০. রজমালনীছড়া চা-বাগান, সিলেট - ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় এবং সর্ব প্রথম প্রতিষ্ঠিত চা-বাগান ওপার বাংলায়। নাম, রজমালনীছড়া চা-বাগান। ১৮৪৯ সালে লর্ড হার্ডসনের তত্ত্বাবধানে দেড় হাজার একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয় এই চা-বাগান। বর্তমানে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে থাকা এই চা-বাগান ভ্রমণপিপাসুদের কাছে ভীষণ পছন্দের একটি জায়গা। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ানো যায় বাগানে। পৌঁছনোর ঠিকানা - বাস, ট্রেন অথবা বিমান, এই তিন রুটের যেকোনও একটা ব্যবহার করে ঢাকা থেকে প্রথমে আসতে হবে সিলেট। এর পর শহরের যে কোনও জায়গা থেকে রিকশ কিংবা টোটোয়ে সহজেই পৌঁছনো যায় রজমালনীছড়া চা-বাগানে। থাকার জায়গা - এই ১০ দ্রষ্টব্যস্থানেই গেস্ট হাউস, স্টে হোম এবং কোথাও হোটেল আছে। খরচ-খরচা বছরের বিভিন্ন সময়ে ওঠা-নামা করে পর্যটকদের আনাগোনার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশি মুদ্রায়।