বিধান সরণি এ্যাটলাস ক্লাবের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ‘পোস্ত’
পুজোর বোধনের অনেক আগেই বিসর্জন হয়ে এক পুজো কমিটির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ‘পোস্ত’র! এ বছরেরই ২০ অগস্ট পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল সে। তার শোকে ম্রিয়মাণ তার পাড়া। শ্যামবাজারের ‘মাটির গলি’।
পোস্ত মানুষ নয়। পোস্ত সারমেয়। জাতে ল্যাব্রাডর। আর তাকেই সাদরে পুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করেছিল ও পাড়ার ‘বিধান সরণি এ্যাটলাস ক্লাব’।
মাত্র সাড়ে ৩ বছর বয়সে তার জীবনের ইতি হয়ে গেল। হৃদ যন্ত্রের বিকল, দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে পোস্ত ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। সে ঘটনার পর মুহ্যমান তার ‘পিতা’ ঋতম ভট্টাচার্য। ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক। ২৮ বছর বয়সি ঋতম ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের কর্মী।
ফিরে যাই পুজোর গল্পে। পোস্তকে ব্র্যান্ড আম্বাসাডর করার কাহিনিতে। কেন এমনটা ভেবেছিল ‘মাটির গলি’ পাড়ার ওই ক্লাবটি?
গুগল ঘাঁটলে এমন ঘটনার নজির পাবেন বিদেশে। যেখানে কোনও সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়েছে কোনও সারমেয়। কিন্তু ভারতে বা বিশেষ করে কলকাতায় এমনটা আগে ঘটেছে কি? জানা নেই। অভিনব এই কাণ্ডটির একটি নেপথ্য কাহিনি আছে। তার মোদ্দা গপ্পোটি লুকিয়ে আছে গত বছরের পুজোয়। গত বছর থেকেই এই ক্লাবের উদ্যোগে শুরু হয়েছে বিশ্বের প্রথম পোষ্য-বান্ধব দুর্গাপুজো। এমনটাই দাবি ক্লাবটির। সে কারণেই পশুপ্রেমী এই ক্লাব-সদস্যরা পোস্ত-কে তার ‘মুখ’ করে।
পোষ্য-বান্ধব পুজো? সে আবার কী! বিষয়টা খোলসা হল ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে। কী বললেন তাঁরা? বলি তা হলে।
পোষ্য-বান্ধব পুজো। আয়োজনটি ভারী অদ্ভুত। সদস্যরা জানালেন কী ভাবে এবং কেন এমন উদ্যোগ তাঁরা নিয়েছিলেন! তাঁরা বললেন, ‘সাধারণ মানুষ যখন দুর্গাপুজোর আনন্দে মেতে ওঠেন, সেই সময় আমরা সবাই লক্ষ করি, রাস্তায় ভিড়ের মাঝে পোষ্যদের রোজকার হাঁটাটাও কী ভীষণ ভাবে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে! পোষ্যদের কষ্ট হচ্ছে বুঝেও কিছু করার থাকে না তার ‘অভিভাবকদের’। এই কষ্টকে অন্তত আমাদের পাড়ায় নির্মূল করতে এমন পোষ্য-বান্ধব আমরা পুজোর চালু করি গত বছর থেকে।’
বাডি
তো, কী হয়েছিল, কেমন আয়োজন ছিল পোষ্য-ভাবনা সম্বল করা এই মণ্ডপে? সদস্যরা বললেন, ‘এই পুজোয় পোষ্যরা মণ্ডপে নিশ্চিন্তে যাতে ঢুকতে পারে, তা খেয়াল রেখেছিলাম আমরা। এমনকী ওদের জন্য আলাদা প্রবেশ-পথের ব্যবস্থাও আমরা করেছিলাম।’ শোনা গেল, সারমেয়দের কথা মাথায় রেখেই গত বছর এঁরা পুজোর থিমের নাম দিয়েছিলেন ‘অনন্ত আশ্রয়’।
আর কী কী করেছিলেন? ওঁরা জানালেন, প্রতিপদ থেকে তৃতীয়া, মন্ডপে বরং প্রবেশ নিষেধ ছিল সাধারণ দর্শনার্থীদের। শুধু মাত্র অভিভাবকের সঙ্গে প্রবেশ করতে পেরেছিল তাঁদের আদরের পোষ্যরা। একটি ‘হেলপ লাইন নম্বর’ও চালু করা হয়েছিল উদ্যোক্তাদের তরফে। সেই নম্বরে ফোন করে আগে থেকে অভিভাবকদের রেজিস্টার করিয়ে রাখতে হয়েছিল পোষ্যদের নাম। সঙ্গে ছিল আলাদা প্রবেশ-পথ। যেখান দিয়ে পোষ্যদের পুরো মণ্ডপ ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছিল। এই ধরনের অভিনব পদক্ষেপ অন্তত এই শহরে আগে দেখা গিয়েছে কি? জানা নেই।
এ বছরেরও সেই পথেই হাঁটছেন ক্লাবটি। এ বছরেও সারমেয়দের জন্য থাকছে বিশেষ কিছু উদ্যোগ। থাকছে ভিআইপি লাইন। সঙ্গে আপৎকালীন সমস্যা নিরাময়ের জন্যও কিছু ব্যবস্থা। এ ছাড়াও এ বছরের সবচেয়ে অভিনব উদ্যোগ হচ্ছে, মণ্ডপে থাকছে পোষ্যদের প্রীতিভোজের ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের মতো পোষ্যরাও এ বছর গ্রহণ করবে মায়ের প্রসাদ।
ক্লাবের এক উদ্যোক্তা আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন, এ বছরে তাঁদের ক্লাবের ‘মুখ’ পোস্তকে নিয়ে বিশেষ কিছু করার চিন্তা ভাবনা ছিল। দুর্ভাগ্যবশত তা আর ফলপ্রসূ হবে না। কিন্তু এ বারের পুজোয় ‘পোস্ত’ না থেকেও থেকে যাবে। শুধু এ বার বলে নয়, চিরদিনের জন্য পোস্তকে তাঁরা জমার খাতায় রেখে দেবেন বছরের পর বছর।
ওদের কথায়, ওদের বাসনায়, ওদের আবেগে ‘পোস্ত’ থেকে যাবে এ ভাবেই! এ যেন সেই অতি পরিচিত গানের মুখড়া, হৃদমাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেব না’! গানের পরের লাইনটা মনে করুন, ‘ছেড়ে দিলে সোনার হরিণ আর তো পাবো না’। পোস্ত হরিণ নয়, সারমেয়। পোস্তকে ছাড়তে না চেয়েও ছেড়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু পোস্তর শরীরে না হলেও ওই মাটির গলি-র হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে চিরদিনের জন্য। যে কারণে এখনও পোস্ত-র ‘বদলি’ ভেবে উঠতে পারেননি তাঁরা!
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।