ভরা বর্ষার পর পূর্ণগর্ভা অজয়ের জোলো, ভিজে বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে মন্দির প্রাঙ্গণের সমবেত মানুষজনকে। চতুর্ভুজা মৃন্ময়ী মা'য়ের পদতলে অধীর আগ্রহে বসে আছেন এক পটুয়া। এক প্রহর পর পূজা। কিন্তু মায়ের রং হয়নি এখনও! রেড়ির তেলে ভরা বৃহৎ প্রদীপ সার দিয়ে জ্বলছে আড়াল করা প্রাঙ্গণে। সন্ধ্যাকেও দিন বলে ভ্রম হচ্ছে। আর সেই শিখার উপর তেপায়ার রাখা আছে মাটির বড় বড় সরা। প্রদীপের শিখায় মাটির সরায় ভুশোকালি পড়বে। পুজারাম্ভের ঠিক এক প্রহর আগে ওই কালি দিয়েই মায়ের রং ও শৃঙ্গার করা হবে। হ্যাঁ, এমনটাই রীতি ছিল মায়ের মূর্তি রং করার!
এখান থেকে চলে যাই হাড়কাটা মন্দিরের কালী মা অপভ্রংশে হড়কা কালী মায়ের কাহিনিতে। প্রাচীন বীরভূমি বা বীরভূমের অজয় তীরে এক প্রাচীন দেব মন্দির এই হাড়কাটা মন্দির।
মন্দিরের প্রাচীনত্ব বোঝা যায়, তার জোড় বাংলা বা প্রাচীন মন্দির শৈলী ও টেরাকোটার কাজ থেকে। এই মন্দিরে তার নমুনা অসংখ্য। গ্রামবাসীদের মতে, যত দূর জানা যায়, এই মন্দির এবং অদূরবর্তী কেশবাইচণ্ডী তলার মন্দির— এই দু’টি মন্দিরই একান্ন পীঠের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং কালাপাহাড় কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিল।
এই স্থানের অস্থিশিল্পের বেশ সুনাম ছিল। এইখানে প্রধানত অস্থিশিল্পীদের লোকজন বসবাস করতেন। এবং তাঁরা ষোড়শ শতকে বাণিজ্য করতে আসা বিট্রিশদের অস্থি থেকে বিভিন্ন কারুকার্যমন্ডিত শিল্প সামগ্রী তৈরি করে দিতেন। এই সামগ্রীর ইউরোপে দারুণ চাহিদা ছিল।
এইভাবে উপার্জিত অর্থ দ্বারা অস্থিশিল্পী তোতারাম মতোবিগঁর নেতৃত্বে সমগ্র অস্থিশিল্পীরা একত্রিত হয়ে মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি ও নয়নাভিরাম মন্দির গড়ে পূজাপাঠ শুরু করেন। যেহেতু অস্থি (হাড়) শিল্পীদের দ্বারা নির্মিত মন্দির, তাই এই মন্দিরের নাম ‘হাড়কাটা’, আবার ১৭৫১ সালে বর্গী আক্রমণে প্রায় ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছিল।
এ বারে মূর্তি প্রসঙ্গে আসি। মূর্তি ও কিংবদন্তি। মন্দিরে মায়ের যে মূর্তি তা প্রধানত দক্ষিণা কালী। তাঁর ডানের উর্ধ হস্তে খড়্গ ও অধ হস্তে মুণ্ড। এবং বামের উর্ধ হস্তে বর ও অধ হস্তে অভয় মুদ্রা। মা শবশিবে দণ্ডায়মানা। কিন্তু মা এখানে একই সঙ্গে ভীষণা এবং একই সাথে বরাভয়প্রদায়নী।
১২০ শের আতপ চাল ও বিবিধ ফলমূলের দ্বারা পূজা হত। শোনা যায়, এখানে মা ভীষণই জাগ্রত। কোনও এক সময়ে মূল সেবাইতের দ্বারা কিছু ত্রুটি হলে, তাঁর দ্বাদশ বর্ষীয়া কন্যা নিখোঁজ হন। এবং তাকে খুঁজতে খুঁজতে বিগ্রহের মুখে রক্ত ও কাপড়ের টুকরো দেখতে পাওয়া যায়। তখন মায়ের কাছে আকুল হয়ে ডেকে সেই সেবাইত কন্যাকে ফিরে পান। তাই মা এখানে ভীষণা হলেও মঙ্গলময়ী।
মন্দির ধ্বংস হয়ে এলে, ধীরে ধীরে মন্দিরে পূজা কমে আসতে থাকে। কেবলমাত্র বাৎসরিক দীপান্বিতা অমাবস্যার অন্যান্য পূজা গুলোই সংঘটিত হয়। আমরা এই স্থানের আবার ইতিহাস পেতে শুরু করি এক ব্রিটিশ সাহেবদের ম্যাপ থেকে। সেখানে তিনি এই স্থানের নাম "ইতন্ডা" বলে চিহ্নিত করেছেন। সেই নামই এখন বর্তমান। বীরভূমের সুরুল এবং ইতন্ডা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ‘নীল ঘাঁটি’ ছিল। তাই গ্রামটিতে গড়ে উঠেছিল। তাই মায়ের পূজাও চলত। কিন্তু ধীরে ধীরে পতনোন্মুখ হয়ে পড়েছিল।
এর বহু বছর পর, হালে "কালচারাল হেরিটেজ ট্রাস্ট" এর নজরে আসে বিষয়টি এবং এক টানা ১৪ বছর ধরে সংস্কার করে মন্দিরের টেরাকোটা প্লেটগুলি পুনঃস্থাপিত করে মন্দিরটিকে বাঁচানো হয়। চাইলে আজও গিয়ে দর্শন করে আসতে পারেন সেই মা এবং মন্দিরকে। এমন অপরূপ টেরাকোটার কাজ এবং জোড় বাংলা মন্দির স্থাপত্যশৈলী সত্যিই দুর্লভ!
বোলপুর স্টেশনে নেমে গাড়িতে ইতন্ডা গ্রাম মাত্র কুড়ি কিলোমিটারের পথ। গ্রামে গিয়ে নিজে পায়ে হেঁটেই দেখে নিতে পারবেন এই গ্রামের সতীর উপপীঠগুলি। ঋণ: মুক্তির আশে শক্তির পাশে (গবেষক সত্যরঞ্জন দাস), বীরভূম. ওআরজি এবং বিবিধ ক্ষেত্র সমীক্ষার প্রবন্ধ পত্র। এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।