১৩২৬ বঙ্গাব্দ। বিস্তৃর্ণ মানভূম অঞ্চল জুড়ে দেখা দিল কলেরার প্রকোপ। হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে লাগলেন। মহামারীর প্রকোপ রুখতে পুরুলিয়ার জয়পুর রাজ এস্টেটের জমিদার গৌর সরকার ঠিক করলেন ঘাঘরা গ্রামে মাতৃ আরাধনা করবেন। ধুমধাম করে সে বছর হল দুর্গাপুজো। শোনা যায়, সমবেত প্রার্থনার ফলও মিলেছিল তখনই। কলেরার প্রকোপ কমল এলাকায়। জীবন ফিরে পেলেন বহু মানুষ। তার পর থেকেই প্রতি বছর দুর্গাপুজো হয়ে আসছে ঘাঘরার সরকার বাড়িতে। দেখতে দেখতে এই পুজো আজ একশো চার বছরে পা দিল।
পুরুলিয়ার গড় জয়পুর এলাকার এই ঘাঘরা গ্রাম পত্তনের ইতিহাস হিসেবে জানা যায়, এই এলাকা ছিল ওঝাদের। জমি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে রাজার বিবাদ বাধে। সরকার বংশের আদিপুরুষ গৌর সরকার তখন জয়পুর রাজার সঙ্গে ওঝাদের দীর্ঘ দিনের সমস্যার সমাধান করে দেন। রাজা খুশি হয়ে তাঁকে যতদূর চোখ যায়, তত দূর পর্যন্ত জায়গা দান করেন। এ ভাবেই জয়পুরের ঘাঘরা গ্রামে এলেন সরকারদের বাস শুরু।
এক সময়ে দেবী দুর্গার আরাধনা হত মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালার মন্দিরে। পরে এক বার একটি দুর্ঘটনায় মন্দিরের দেওয়াল চাপা পড়ে মারা যান দু’জন। গৌর সরকারের উত্তর পুরুষ মেঘনাদ সরকার এবং যজ্ঞেশ্বর সরকার তখন পাকা মন্দির বানিয়ে দেন। তা-ও প্রায় সত্তর বছর হবে। সেই মন্দিরেই এখন পুজো হয়।
প্রাচীন রীতি মেনে মন্দিরেই তৈরি হয় একচালার দেবী প্রতিমা। সপ্তমীর দিন গুয়াই নদী থেকে আনা হয় জল এবং স্থাপন করা হয় নবপত্রিকা। তন্ত্র মতে হয় দেবীর পুজো। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর দিনে হয় পাঁঠা বলি। একটা সময় ছিল যখন মোষ বলির রেওয়াজ ছিল। সপ্তমী এবং অষ্টমীর দিনে এখন একটি করে পাঁঠা বলি হয়। নবমীর দিন হয় প্রায় দেড়শো পাঁঠা বলি। যা দেখতে ভিড় করেন আশপাশের দশ-বারোটি গ্রামের মানুষ।
পুজোর শুরু থেকেই তিন দিন গ্রামের মানুষকে পাতপেড়ে খাওয়ানোর রেওয়াজ চলে আসছে। মন্দিরের পুরোহিত আসেন পুরুলিয়া ও জয়পুরের 'সিধি' অঞ্চল থেকে। যে কারণে তাঁরা 'সিধি ব্রাহ্মণ' নামে পরিচিত। এই সিধি ব্রাহ্মণেরা বংশ পরম্পরায় সরকার বাড়ির পুরোহিত।
সরকার বাড়ির পুজোয় অষ্টমীর তুলনায় নবমীর মাহাত্ম্য বেশি। যে কারণে নবমীর বলির সময়ে ছিল কামান দাগার রেওয়াজ। পরে চুয়াড় বিদ্রোহ চলাকালীন কামানটি খোয়া গেলে বন্দুক ছোড়া হত। গত দশ বছর হল বন্দুক ছোড়ার সেই রেওয়াজও বন্ধ হয়ে গেছে। নবমীর রাতে এক সময়ে রাতভর হত ঝুমুর নাচ। বসত যাত্রার আসর। হত ছৌ-নাচও। এখন সে সব অতীত। সে ভাবে আর অনুষ্ঠান হয় না। তবে নবমী-দশমীতে মেলা বসে।
অতীতে কাহারদের কাঁধে চেপে বিসর্জন হত দেবীর। বিসর্জন হত ওঝা বাঁধে। সে রেওয়াজ আজও রয়েছে। এখন অবশ্য গ্রামের লোকজন কাঁধে করে এক কিলোমিটার দূরের ওঝা বাঁধেই বিসর্জন দেয় দেবী প্রতিমা। সরকার বাড়ির উত্তরসূরিদের কথায়- "মন্দিরের নিজস্ব জমি-জায়গা, পুকুর রয়েছে। সেখান থেকে একটা আয় আসে ঠিকই, কিন্তু পুজোর খরচ বেড়েছে। চারপাশের অনেকগুলো গ্রাম মিলে একটাই পুজো। যেখানে সবাই অংশগ্রহণ করে। ফলে প্রতি বছর চাপ বাড়ছে। সরকারি কোনও সাহায্য নেই। দু’বছর হল পারিবারিক পুজোকে তাই আমরা সর্বজনীন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।