মা দুর্গার ভোগ মানে তো আর যে সে ব্যাপার নয়! যেমন তার আয়োজন, তেমনই তার রান্না আর তার সঙ্গে মানানসই তার পরিবেশন। যে চারটে দিন মা আমাদের কাছে থাকবেন, তিনি তো দুটো মুখেও দেবেন আমাদেরই কাছে। আর সে ব্যাপারে যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে সে জন্য যারা এখানে তাঁর দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে তাদের চিন্তার আর অবধি থাকে না। আগে দুর্গাপুজো হত রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়িতে। কালে কালে সম্ভ্রান্ত এবং অবস্থাপন্ন বাঙালিদের বাড়িতেও এই পুজোর প্রচলন ঘটে। আসলে দুর্গাপুজো দীর্ঘ দিন বাড়ির পুজো হিসেবেই ছিল। তারপর তা হয়েছিল ‘বারোয়ারি’ বা বারো ইয়ারি, অর্থাৎ বারো জন বন্ধুর চাঁদার টাকায় এবং শেষকালে হয়েছিল ‘সর্বজনীন’, অর্থাৎ জনসাধারণের চাঁদার টাকায়।
আগে রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ির পুজো উপলক্ষ্যে আশপাশের আট-দশটি গাঁয়ের মানুষ প্রায় দিন পনেরো ধরে সেখানে দু’বেলা পাত পেড়ে খেত। এরা দুর্গাপুজো সংক্রান্ত কোনও না কোনও কাজে জমিদারবাড়ির সঙ্গে ঠিক জুতে যেত। যেমন ধরা যাক, পুজো যেখানে হবে সেই বিরাট জায়গাটি মাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিচ্ছন্ন করার জন্য একদল ঘরামি প্রজা ব্যস্ত হয়ে উঠত। তাদের আর এক দল লেগে পড়ত ভেতর-বাড়ির বিরাট উঠোনের একপাশে বাঁশের চালা করে, ওপরে খড় বিছিয়ে কিংবা শামিয়ানা টাঙিয়ে অস্থায়ী রান্নাঘর তৈরি করতে। মাটিতে সবাইকে বসতে দেওয়ার জন্য তালপাতা বা খেজুরপাতার হাজার দু’য়েক চাটাই সারা দিন বুনে যেত ঘরামি বউরা।
উৎসবের দিনে দুধ, ঘি, ছানা জমিদারবাড়ির ভাঁড়ারঘরে পৌঁছে দিয়ে যেত গোয়ালপাড়ার বাসিন্দারা। খেতের টাটকা আনাজ-সব্জি প্রতি দিন রান্নাঘরে জোগান দিত একদল কৃষক। তেমনই নিজে থেকে হাজির হয়ে যেত সব্জি ধোয়ার, কুটনো কোটার এবং খান পনেরো বিশাল উনুনে সারাদিন ধরে রান্না করে চলার পাচক এবং তাকে সাহায্য করা জোগাড়ের দল। জমিদারবাড়ি লাগোয়া তিন-চারটে পুকুর থেকে বড়সড় রুইমাছগুলো বেছে নিয়ে অন্য ছোট পুকুরে ছাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ত জেলে সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ। সেগুলো যথা দিনে ভোরবেলায় জাল দিয়ে তুলে জমিদারবাড়ির রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছেও দিত তারা। মাছ কোটবার জন্য দলবেঁধে আসত জেলেবউরা। তারা ছাড়া আর কারও জমিদারবাড়ির মাছ কোটবার হুকুম ছিল না। ওই ক’দিন এই সব কাজের জন্য এরা কেউই কোনও পারিশ্রমিক নিত না। সবটাই করত মনের আনন্দে। কারণ এত বড় সামাজিক এবং সৌহার্দ্যের উৎসব তো আর কিছু ছিল না সেই সময়। তারা শুধু দু’বেলা পেট ভরে খেত।
আরও পড়ুন : শিল্পীর প্রেরণায় প্রতিমার চোখ আঁকেন মধুমন্তী
এই এতগুলো মানুষকে দু’বেলা পেটভরে খাওয়াতে গেলে খুব বেশি ধরনের ব্যঞ্জন তৈরি করা ছিল বেশ অসুবিধেজনক। তাই খাবারের পদগুলি খিচুড়ি, লাবড়া, আলুরদম, চালতা বা আমড়ার অম্বল, বোঁদে— এর মধ্যেই ঘুরপাক খেত। সপ্তমী থেকে নবমী, এই তিন দিন মা দুর্গার জন্য বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা হত। এই ভোগ রান্না হত জমিদারবাড়ির স্থায়ী রসুইঘর এবং ভিয়েনঘরে। এই ভোগের প্রসাদটি পুরোদস্তুর পেতেন জমিদারবাড়ির সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পুরোহিতবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা। পুজোর তিন দিন গ্রামবাসীরা যখন পংক্তিভোজনে বসত, তখন এই ভোগ-প্রসাদের সব ক’টি পদ খানিকটা খানিকটা করে একটি বড় বগিথালায় তুলে নিয়ে মোটামুটি মিশিয়ে দু’জন পরিচারক বয়ে নিয়ে চলত। আর অন্য এক জন প্রত্যেকের পাতে অল্প অল্প করে তা দিয়ে-দিয়ে যেত। সেই সময় ভোগের রান্নায় নুন দেওয়ার কোনও নিয়ম ছিল না, কারণ শাস্ত্রমতে রান্নায় নুন দেওয়া মানেই তা উচ্ছিষ্ট হয়ে গেল। নিম্নবর্ণের মানুষরা কখনও-সখনও তা গ্রহণ করলেও ব্রাহ্মণরা কখনওই তা গ্রহণ করতেন না। আর এ থেকেই নিমন্ত্রণবাড়িতে পাতের একপাশে আলাদা করে কাঁচা নুন দেওয়ার প্রচলন হয়েছিল।
বারোয়ারি পুজোর বেলায় পুজো করতেন প্রধানত বাজারের দোকানদারেরা। পুজোর মণ্ডপ হত বাজারের কাছাকাছি কোনও উঁচু জায়গায়, যাকে বারোয়ারিতলা বলা হত। পুজো না হলেও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বারোয়ারিতলাগুলি কিন্তু এখনও রয়ে গিয়েছে। আর তার কাছাকাছি রয়েছে একটি করে বাজার। বারোয়ারি পুজোয় প্রত্যেক দোকানদারকে বলা থাকত তাদের পুজোর খরচের একটি নির্দিষ্ট অংশ বহন করতে হবে। সেই টাকা থেকেই পুজোর খরচ মিটিয়ে স্থানীয় লোকেদের ভোগ খাওয়ানো হত। খুব স্বাভাবিক, সেই আয়োজন জমিদারবাড়ির পুজোর মতো অত লোভনীয় বা আকর্ষণীয় হত না। তবে পুজোর সংকল্পটি যেহেতু করানো হত কোনো ব্রাহ্মণ সন্তানের নামে, তাই অন্নভোগ হতে কোনও বাধা ছিল না। তা বেশির ভাগ জায়গাতেই তা খিচুড়ি আর লাবড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকত। আর সর্বজনীন পুজোর বেলায় মা দুর্গার জন্য সামর্থ অনুযায়ী ভোগ তৈরি হলেও সেই প্রসাদ জনগণকে খাওয়াবার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। পরের দিকে অবশ্য অষ্টমীপুজোর দিন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মালসায় করে খিচুড়িভোগ বিতরণের ব্যবস্থা হয়েছিল। কাজেই দুর্গাপুজোর ভোগ নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের প্রধানত বাড়ির পুজোর ভোগের কথাই মাথায় রাখতে হবে।
বিবেকানন্দের মেজোভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় পাওয়া যায়, দুর্গাপুজো যদি কোনও ব্রাহ্মণবাড়িতে হয় তবে সেখানে অন্নভোগের বিধান থাকে। কায়স্থবাড়িতে মা’কে লুচি খেতে দেওয়া হয়— কিন্তু সেটাকে তো ঠিক ভোগ বলা চলে না! ওপার বাংলায় অবশ্য কায়স্থরাও অন্নভোগ দিয়ে থাকেন এবং তাঁরাই যখন পরবর্তীকালে এ বাংলায় এসেছেন, তখন তাঁদের বাড়ির পুজোতেও সেই রীতিই বজায় ছিল। আবার বৈষ্ণব ব্রাহ্মণের বাড়ি হলে সেখানে সমস্ত ভোগই নিরামিষ কিন্তু শাক্তবাড়ি হলে সপ্তমীতে রুইমাছ এবং নবমীতে ছাগলের মাংস নিবেদন করা চলত। ওপার বাংলা হলে অবশ্য রুইয়ের জায়গায় বোয়াল হত। তবে দুই বাংলাতেই কিন্তু ভোগের আমিষে পেঁয়াজ-রসুন দেওয়ার বিধান ছিল না। মহেন্দ্রনাথেই পেয়েছি, বৈষ্ণববাড়ির মা দুর্গার সিংহের মুখ ঘোড়ার মতো এবং শাক্তবাড়িতে তা সাধারণ সিংহেরই মতো। সিংহের মুখের গড়ন দেখে মানুষ বুঝতে পারত সপ্তমী বা নবমীর ভোগের প্রসাদে আমিষ থাকবে, না থাকবে না।
আরও পড়ুন:পূজাবার্ষিকীর সঙ্গে ঘরে আসত দু’চারটে ক্যাসেটও
আগে পুজোর ভোগ হিসেবে খুবই প্রচলিত ছিল অথচ এখন আর নানা কারণে হয় না, এমন কয়েকটি পদের নাম করতে বললে প্রথমেই বলতে হয় সাদা ধবধবে ঘি-ভাতের কথা। ঘি-ভাত মানে কিন্তু কখনওই পোলাও নয়। ভুরভুরে গন্ধওয়ালা পুরনো গোবিন্দভোগ চালকে, গরুর দুধের সর-তুলে বানানো ঘিয়ের সঙ্গে সামান্য নেড়েচেড়ে ঘি-ভাত তৈরি করা হত। কোথাও কোথাও তাতে আবার সামান্য তেজপাতা এবং কাজুবাদাম পড়ত। এর পরের হারিয়ে যাওয়া পদটি হল আমআদা দিয়ে সোনামুগের ডাল। এটা কিন্তু আহামরি কিছুই নয়। আমআদা থাকায় ডালটিতে অদ্ভুত একটা গন্ধ বেরত, যার তুলনা অন্য কোনও গন্ধের সঙ্গে করা চলে না।
এর পরের পদটি অতি সাধারণ হলেও ইদানীং হারিয়ে যাওয়া ভোগের পদের তালিকার প্রায় শীর্ষে উঠে বসে আছে। এই পদটির নাম বেগুন বাসন্তী। লম্বা করে কাটা ল্যাজওয়ালা বেগুনের ওপর ঝাল-ঝাল সাদা সরষে এবং মিষ্টি-মিষ্টি নারকোল কোরার পরত মাখানো। সন্ধেবেলায় মা দুর্গা এবং তাঁর ছোট ছেলেমেয়েদের ফুলকো লুচির সঙ্গে এটি পরিবেশন করলে গৃহস্থের জীবনে সৌভাগ্যের উদয় হয়। তার কোনও সাধই আর অপূর্ণ থাকে না। বেগুন বাসন্তীর পর এ বার আসি পানিকচুর ফিকে সবুজ লতিতে। নিরামিষ কচুর লতি রাঁধতে হলে সরষের তেলে কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে বহু ক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করে, শেষে নামানোর আগে ওপরে কিছুটা নারকোল কোরা ছিটিয়ে দিতে হয়। তবে বিশাল সাইজের একটি কড়ায়, বিরাট লম্বা একটি খুন্তি দিয়ে এক-কড়াই কচুর লতি নাড়াচাড়া করা যে কী পরিমাণ শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এটা নিশ্চয়ই বলে বোঝাবার দরকার নেই। কচুর লতির মতোই আরও একটি ভোগের পদ হল কাঁচা ছোলা, নারকোল কোরা, ঘি, গরমমশালা সহযোগে তৈরি মোচার ঘণ্ট। অত মোচা কুটবে ক’জনে, এই প্রশ্নটির জন্যই বোধহয় বর্তমানে ভোগের পদ থেকে মোচার নাম কাটা গিয়েছে।
সাবেককালে তিন ধরনের ডালনা মা দুর্গার জন্য ঘুরেফিরে রান্না করা হত। পেঁপের ডালনা, আলু-কাঁচকলা-পটলের হলুদ ছাড়া সাদা ডালনা আর ছানার ডালনা। এর মধ্যে প্রথম দু’টির চল প্রায় উঠে গিয়েছে। টাটকা গরুর দুধকে পাতিলেবু দিয়ে ছানা কাটিয়ে, ভাল ঘিয়ে তা দিয়ে গোল গোল বড়া ভেজে ফেলে, তাকে ডুমো-ডুমো আলু, গরমমশলা, আদাজিরে-বাটা দিয়ে ফুটিয়ে মিষ্টি-মিষ্টি ছানার ডালনা তৈরি করা হত। যা ছাড়া কোনও সাবেক পুজোবাড়ির অষ্টমীর ভোগ কল্পনাই করা যেত না। বর্তমানে ছানার বড়া তৈরির হ্যাপা এড়াবার জন্য অনেকেই পনিরের শরণাপন্ন হয়েছে। তবে পনিরকে কোনও সাবেক বাড়ির ভোগে কিন্তু এখনও দেখতে পাওয়া যাবে না, কারণ এতে নাকি প্রাণিজ প্রোটিন মিশে থাকে।
এর পর ভোগ হিসেবে আগেকার দিনে অত্যন্ত জনপ্রিয় এমন দু’টি মাখোমাখো নিরামিষ পদের নাম করব। যারা হল, এঁচোড়ের কোপ্তা এবং ডুমুরের কোপ্তা। সে সময় এই ধরনের পদগুলি ঠিকঠাক রাঁধতে পারতেন যে পাচক, পুজোর সময় তাঁদের কদর খুব বেড়ে যেত। ঠিক যেমন খাতির করা হত, বলি হওয়া কচি ছাগলের মাংসকে পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া শুধুমাত্র লঙ্কা-আদা-জিরে বাটা দিয়ে নিরামিষ মতে রেঁধে দেওয়ার পাচক ঠাকুরটিকে। এই পদটিও কালে কালে বাংলার বুক থেকে প্রায় হারিয়েই গিয়েছে। দশমীর দিন সকালবেলায় বহু পুজো বাড়িতেই পোলাওয়ের সঙ্গে মাছ বা মাংস খাওয়া হত, তবে এটা কিন্তু দেবীকে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হত না। আবার ওপার বাংলার পাবনা, চট্টগ্রামের মতো জায়গার পুজোবাড়িতে এ দিন পান্তাভাত, জোড়া ইলিশ এবং সামান্য আখের গুড় আর তেঁতুলের ক্বাথ দিয়ে বানানো পদ্মের নালের টক হয়ে থাকে। খুলনা এবং বিক্রমপুরে হয় শাপলা ফুলের নালের টক। আবার এ পার বাংলার বর্ধমান বা কৃষ্ণনগরের মতো পুরনো জায়গার পুজোয় মৌরলা মাছের টক খাওয়ার প্রথা আছে।
আগে বাড়ির পুজোর ভোগের অন্যতম আকর্ষণ ছিল তার ভিয়েন। রকমারি মিষ্টির সুগন্ধে বাড়ি যেন ম’ম’ করত। রসবড়া, লবঙ্গলতিকা, নারকোল ও তিলের নাড়ু, মুড়ি ও চিঁড়ের মোয়ার সঙ্গে তৈরি হত পূর্ণচন্দ্রপুলির মতো সাবেক মিষ্টি। এটা আর কিছুই নয়, দু’টি চন্দ্রপুলিকে ব্যাস বরাবর জুড়ে দিলে যে বৃত্তাকার মিষ্টিটি তৈরি হয়, সেটাই। বিজয়া দশমীতে আগে বাড়ির পুজোগুলিতে থালা থালা নারকোল ছাবা তৈরি করে সরবরাহ করা হত, এ তথ্যটিও মহেন্দ্রনাথ দত্ত ভারি যত্ন করে লিখে রেখে গিয়েছেন।
কার্টুন : দেবাশীষ দেব