পুজোয় শাড়ি নয়, জুতো নয়, লিপস্টিক নয়, ভ্যানিটি ব্যাগ নয়, হাতঘড়ি নয়, শেষে কিনা উল্কি! উল্কি একটা পুজোয় নেওয়ার মতো জিনিস হল? ভোরবেলা ময়দানে চরতে আসা ভেড়া-ছাগলদের গায়েও তো উল্কি দেখা যায়। অথচ দেখুন, এখন কলকাতার ছেলেমেয়েরা পুজোর সময় গায়ে সেই উল্কি আঁকাবার জন্যেই কিনা মাথা খারাপ করে ফেলছে! শরীরের কোথায় আঁকানো হবে, কীসের ছবি বা কোন কথাগুলি লেখানো হবে, এগুলোই আজ ষোলো থেকে ছাব্বিশের মূল আলোচনার বিষয়। অবশ্য এই ভাবে বয়স বেঁধে দেওয়াটা বোধহয় ঠিক হল না, কারণ বাহান্ন বা বাষট্টির নারীপুরুষরাও যে নিজেদের শরীরে উল্কি করাচ্ছেন না, তা কিন্তু মোটেও নয়। তবে তার হার হয়তো তুলনামূলক ভাবে কম।
প্রথমে শুনে ভারি আশ্চর্য হয়েছিলাম, উল্কির জন্ম নাকি যিশুখ্রিস্ট জন্মাবার কয়েক হাজার বছর আগে। প্রাচীন মিশরের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের মমি হওয়া শরীরে নানা ধরনের উল্কির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। পৃথিবীর নানা জায়গার আদিবাসীরা শরীরে বিশেষ ধরনের উল্কি এঁকে, নিজেদের অন্য গোষ্ঠীর থেকে আলাদা রাখতে চাইত। এই উল্কিগুলি বেশির ভাগই ছিল পশুপাখি কিংবা সরু-মোটা রেখার আঁকিবুকি। পরে কয়েদিদের শরীরে উল্কি আঁকার প্রচলন হয়েছিল। এগুলি প্রধানত ছিল হরফ নির্ভর। আরও পরে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ভেসে বেড়ানো জাহাজি নাবিকদের হাতে নোঙর ও জাহাজের উল্কি করা থাকত।
জ্ঞান হওয়ার পর আমরা যাঁদের গায়ে উল্কি দেখেছি, তাঁদের আস্তানা ছিল মেথরপট্টি বা ডোমপট্টিতে। ভারতবর্ষে একটা প্রাচীন লোকবিশ্বাস ছিল, উল্কি নাকি মানুষের দেহের স্থায়ী অলঙ্কার এবং মানুষ মৃত্যুর পর ওই উল্কিগুলি বিক্রি করে হাসিমুখে স্বর্গে যেতে পারবে। এটা তারই প্রতিফলন কি না কে জানে! কিছু বৈষ্ণব এবং শাক্ত ভিক্ষুকও দেখেছি যাঁদের শরীরে ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ কিংবা ‘হর হর মহাদেব’ লেখা উল্কি করা রয়েছে। বেনারস এবং পুরীতে গিয়ে দেখেছি হিন্দি এবং ওড়িয়া ভাষায় দেবতার নাম লেখা বিশেষ ধরনের উল্কি। তাই ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ বেনারসের মছলিবাবার হাতে, বেমানান এরোপ্লেনের উল্কি দেখে ফেলুদা তাকে জাল বলে চিনে ফেলেছিল। পূর্ণ সিনেমায় ‘দিওয়ার’ দেখতে গিয়ে জেনেছি, বিজয়ের বাঁ-হাতে কারা যেন জোর করে হিন্দিতে ‘মেরা বাপ চোর হ্যায়’ লেখা উল্কি করিয়ে দিয়েছে। আর এখন সেই উল্কিই হয়ে গিয়েছে লেটেস্ট ফ্যাশন ট্রেন্ড। ফ্যাশন জগতের পরিভাষায় যাকে বলা হচ্ছে ‘ট্যাটু’। পলিনেশিয়ান শব্দ ‘ট্যাটাউ’ থেকে ইংরেজি ‘ট্যাটু’ শব্দটি তৈরি হয়েছে, এমনটাই মনে করা হয়। আটের দশকের শেষ দিকে ইউরোপ এবং আমেরিকায় ট্যাটু নিয়ে যে বিশাল আলোড়ন তৈরি হয়েছিল তার ঢেউয়ের ছিটে আমাদের কলকাতা শহরের গায়েও এসে লেগেছিল। তারই ফলস্বরূপ আজ বাঙালি মেয়েদের ঘাড়ের পাশে উঁকি দেয় একজোড়া লাল-নীল মাছ কিংবা কলার বোন ঘেঁষে চুপ করে বসে থাকে একটা ছোট্ট রঙিন প্রজাপতি। বাঙালি পুরুষের বলিষ্ঠ ট্রাইসেপ মাস্লের পিছন দিকে ফুটে ওঠে একটি জিভ বের করা থ্রি-ডি ড্রাগন। এই মুহূর্তে কলকাতা এবং মুম্বইয়ের লেটেস্ট ট্যাটু ট্রেন্ডের মধ্যে যে ডিজাইনগুলোর খুব ক্রেজ তার মধ্যে ড্রিম ক্যাচার (একটি গোল রিংয়ের সঙ্গে আটকানো থাকে বেশ কিছু রঙিন পালক), মাউরি আর্ট (নিউজিল্যান্ডের মাউরি প্রজাতির মতো বিশেষ উল্কি) এবং আউল আইজ-এর কথা সবার আগে বলতে হবে।
আগে পৃথিবীর আদিম অধিবাসীরা নিজেদের গায়ের চামড়ায় জন্তু জানোয়ারের সরু ছুঁচলো হাড় কিংবা বাঁশের কঞ্চির পাতলা তীক্ষ্ণ ফলা বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে নানা রকম উল্কি আঁকত। ছোটবেলায় যে সব উল্কি-শিল্পীদের মানুষের গায়ে উল্কি আঁকতে দেখতাম, তাঁরা ছিলেন ভবঘুরে টাইপের। যে সব স্থানীয় বাজারের কাছাকাছি নিম্নবিত্ত জনবসতি রয়েছে, সেখানে কাঁধে একটা চামড়ার ছোট ব্যাগ নিয়ে এঁদের মাঝে মাঝে ঘুরতে দেখা যেত। দেখা যেত মফস্সল এলাকার মেলায় এবং অস্থায়ী হাটে। আমি নিজের চোখে টালিগঞ্জ বাজারে দু’বার এবং বাস্তুহারা বাজারে এক বার লাইভ উল্কি আঁকা দেখেছি।
এঁরা বেশির ভাগই ছিলেন ফেজটুপি পরা বয়স্ক মুসলমান, নয়তো বিহার বা উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা অবাঙালি হিন্দু। সে সময় পাঁচটি টাকার বিনিময়ে কোনও চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে এঁদের দিয়ে একটি ছোট উল্কি আঁকিয়ে নেওয়া যেত। সাইজে বড় হলে দাম পড়ত এর ডবল। ওই সব উল্কিশিল্পী একটি লম্বা এবং সরু ধরনের সূচ হাতে নিয়ে কাজ শুরু করতেন। ক্যামেরার ফিল্মের একটি ছোট্ট সাদা কৌটোয় খানিকটা তুলো ঠাসা থাকত। আর একটি ছিপিবন্ধ শিশিতে রাখা থাকত খানিকটা কালচে সবুজ তরল। আঁকার সময় প্রথমে চামড়ার ওপর সূচ বিঁধিয়ে-বিঁধিয়ে ছবিটির বর্ডার অনুযায়ী অসংখ্য ফুটো তৈরি করে নেওয়া হত। এই সময় বিন্দু বিন্দু রক্ত বেরিয়ে এলে তা তুলোয় মুছে নেওয়া হত। এর পর একটি সরু তুলির ডগায় করে কালচে তরলটি নিয়ে, ওই সারিবদ্ধ ফুটোগুলির ওপর দিয়ে বুলিয়ে নিলেই, তা চামড়া ভেদ করে নীচে নেমে গিয়ে ছবিটির একটি কালচে অবয়ব ফুটিয়ে তুলত। শেষকালে উল্কি করা জায়গাটির ওপর তেলের মতো অন্য একটি স্বচ্ছ তরল বুলিয়ে, একটুখানি অপেক্ষা করে, জায়গাটা তুলো দিয়ে মুছে দেওয়া হত। খোলা বাজারে ভিড় করে উল্কি আঁকা দেখত বেশ কিছু উৎসাহী মানুষ। এক জনের উল্কি আঁকা শেষ হলে ওই চেয়ারেই বসে পড়ত নতুন কেউ। উল্কি শিল্পী তখন নিজের ব্যাগ থেকে আর একটি মুখবন্ধ কাচের শিশি বের করতেন, যাতে খানিকটা ঘোলাটে সাদা তরল ভরা থাকত। একটিপ তুলোর ওপর ওই তরলটি ফেলে ছুঁচটি মুছে নেওয়াই ছিল সেই সময়ের হাইট অব হাইজিন।
আর এখন আধুনিক ট্যাটু আঁকার যন্ত্রের মুখে আটকানো সূচের সঙ্গেই কালি বেরনোর ব্যবস্থা করা থাকে। এখন সূচও হয় রকমারি। লাইন টানার এবং শেড দেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা সূচ পাওয়া যায়। কেউ যদি একই সঙ্গে দুটি ভিন্ন রঙের কালিতে কাজ করতে চান, তবে তাঁকে দুটি আলাদা কালি ভরা যন্ত্র হাতের কাছে রেডি রাখতে হবে। মানুষ বদলালে সূচও বদলাতে হবে। এখন ট্যাটু আঁকানোর সবচেয়ে কম খরচ হল প্রতি স্কোয়ার ইঞ্চি পাঁচশো টাকা। আর কাজটি যদি কোনও দক্ষ ট্যাটু আর্টিস্ট করেন তবে সেটা হেসেখেলে স্কোয়ার ইঞ্চি প্রতি দু’হাজার কিংবা আরও বেশি টাকার হতেই পারে। এক জন ট্যাটু আর্টিস্ট দক্ষ কি না এটা বোঝা যায় তাঁর সূচ চালানোর ব্যালান্স এবং উদ্ভাবনী চিন্তাধারা দেখে। সারা পৃথিবীতে এখন যে সব অত্যাধুনিক ট্যাটু পার্লার গজিয়েছে, সেখানে আগাম বুকিং করে এঁদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। কলকাতার বুকেও এই ধরনের পার্লারের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
নিজের শরীরের চামড়ার ওপর একটি স্থায়ী লেখা বা আঁকা, যাকে চাইলেও আর কোনও দিনই পুরোপুরি মুছে দেওয়া যাবে না— কেন জানি না এটা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। ভেবেছি, কোনও শব্দ বা ছবিকে নিজের শরীরে এঁকে, আমি নিজের ইমেজকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে ফেলতে যাব কেন? কারণ, মানুষের পছন্দ তো ক্রমাগত বদলায়। আজ যে শব্দ বা ছবিকে আমার পছন্দ হচ্ছে, পাঁচ বছর পরে তাকে আমার পছন্দ না-ও হতে পারে। তখন যদি অনেক চেষ্টা করেও সেই অপছন্দের জিনিসটার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া না যায়, তা হলে তো সাড়ে সব্বোনাশ! এই কারণে, আজ যারা নিজের পুরুষবন্ধু বা মহিলাবন্ধুর নাম নিজের হাতে ট্যাটু করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তিন-চার মাস পরে সম্পর্কটি ভেঙে যাওয়ায় তারাই আবার ফিরে আসছে। বলছে, ওই নামটিকে স্কিন টোন বা লেজার রে দিয়ে চামড়ার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। আর একান্তই যদি সেটা সম্ভব না-হয় তবে সেটাকে নষ্ট করে অন্য কোনও ডিজাইন করে দিতে হবে। এই ধরনের কাস্টমারের সংখ্যা কলকাতা তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন ট্যাটু পার্লারগুলোতে এখন সব থেকে বেশি।
এত কিছু সত্ত্বেও এমন কিছু মানুষ এই শহরেই আছেন, যাঁরা শরীরে ট্যাটু করানোটাকে অত্যন্ত আনন্দের একটা ব্যাপার বলে মনে করেন। তাঁরা ভাবেন, নিজের শরীর এবং সত্তাকে নিয়ে যে কোনও ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করার অধিকার এক জন মানুষের আছে। যেমন, পেশায় স্কুলটিচার চৌত্রিশ বছরের শ্বেতা চক্রবর্তী গেল হপ্তায় নিজের পিঠের ওপর দিকে একটি সাদা সারসের ট্যাটু করিয়েছেন। সারসটি দু’ঠোঁটের মাঝখানে একটি বড়সড় মাছ কামড়ে ধরে রয়েছে। এই পুজো স্পেশাল ট্যাটুটি শ্রীমতী চক্রবর্তীর একেবারেই নিজস্ব কল্পনা। তবে ওঁর স্বামী, বিয়াল্লিশ বছরের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট রোহিত চক্রবর্তীর কিন্তু এই ট্যাটুটি মোটেই পছন্দ হয়নি। সারসে তাঁর আপত্তি নেই। তাঁর অসুবিধে, সারসের ঠোঁটে আটকে থাকা মাছটাকে নিয়ে। তিনি এই অস্বস্তির কথা স্ত্রীকে জানালে, শ্বেতাদেবী বলেছেন, ক’দিন চোখের সামনে দেখতে দেখতে নাকি এটি চোখ-সওয়া হয়ে যাবে। তখন আর কোনও অস্বস্তি থাকবে না। এটা না জানালে অন্যায় হবে, শ্বেতাদেবীর সত্তর পেরনো শাশুড়ি কিন্তু বউমার পিঠের এই উল্কি দেখে অত্যন্ত খুশি। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর কত্তা বেঁচে থাকলে তিনি ঠিক বউমার মতোই এমন একটা উল্কি করিয়ে সব্বাইকে চমকে দিতেন।
অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব