তিন কামরার ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রীতমের তৈরি গ্লাস পেন্টিং, ফেব্রিকের কাজ, রঙিন মাটির পাত্র, কম্পিউটারে আঁকা, প্যাস্টেল এবং জলরঙে আঁকা। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সঙ্গে কয়েকটি প্রদর্শনীও হয়ে গিয়েছে তাঁর। পুরস্কারে ঠাসা ঘরের দেরাজ। গত বছরই নারী ও শিশু বিকাশ এবং সমাজকল্যাণ দফতরের তরফে গান ও আঁকার জন্য রীতমকে পুরস্কৃত করেছেন দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা। ছেলের যাবতীয় কাজ নিয়ে আগামী বছর একক প্রদর্শনীর কথা ভাবছেন শর্মিলা দাস এবং অরুণকুমার দাস। বাড়ি সাজাতে গিয়ে শুধু রীতমের কথাই ভেবেছেন ওঁরা। অটিজ়ম ও আরও কিছু সমস্যা থাকায় একটানা কাজ করতে পারেন না রীতম। হাতের কাজ, গান এবং অ্যাথলেটিক্সে উৎসাহী এই যুবক। “কোনও কাজ থেকে মন উঠে গেলে যাতে অন্য কাজে ওকে বসিয়ে দেওয়া যায়, সে জন্য সবটাই রীতমের নাগালে থাকে। কাজ নিয়ে আমার পরামর্শও পছন্দ নয়, নিজে যা মনে করবে সেটাই করে।”― বলছিলেন শর্মিলা।
দুর্গাপুজো-কালীপুজো উপলক্ষে গত তিন বছর ধরে গানের অনুষ্ঠান করছেন রীতম। তবে মণ্ডপ সাজানোর কাজ এ বছরই প্রথম। এ কাজ করতে কেমন লাগছে? এক গাল হেসে তাঁর সহজ উত্তর, “খুব ভাল। গণেশের মুখ সব থেকে ভাল লাগে।”
কয়েক বছর আগে দমদমের সেন্ট স্টিফেন্স থেকে আইসিএসসি পাশ করেছেন রীতম। আগামী বছর দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিং থেকে অনলাইনে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় বসবেন। অটিজ়মের জন্য চলাফেরায় যাতে শিথিলতা না আসে, স্থূলতার শিকার না হতে হয়, তাই প্রতিদিন খেলাধুলো, ব্যায়াম করেন রীতম। একমাত্র সন্তানের সব কাজের সঙ্গী বেসরকারি সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক অরুণবাবু এবং তাঁর স্ত্রী শর্মিলা।
রীতমের যখন তিন বছর বয়স, তখনই ওর ব্যবহারে সমস্যা দেখে মনোরোগ চিকিৎসককে দেখানো হয়। কাউন্সেলিং, আই-কিউ পরীক্ষা করে বাবা-মাকে কিছু পরামর্শও দেন তাঁরা। সে ভাবেই সব চলছিল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে এক দিন স্কুলেই অসুস্থ হওয়ায় রীতমকে ভেলোর নিয়ে যান অরুণবাবুরা। তখনই জানতে পারেন অটিজ়মে আক্রান্ত ছেলে। অরুণবাবু বলেন, “এর পরেই ওর পছন্দের বিষয় নিয়ে ওকে উৎসাহিত করতে শুরু করি। সব কিছু বাড়িতেই শেখানো হয়, কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত। তাদেরই একটি সংস্থার তরফে পুজোয় সাজানোর দায়িত্ব পেয়েছে।”
১২-১৩ বছর ধরে রীতমের আঁকার শিক্ষক সুব্রত রায়চৌধুরী। তাঁর কথায়, “ওর মধ্যে রং বানানোর ক্ষমতা রয়েছে। জলরং, প্যাস্টেল ওয়ার্কে বেশি স্বচ্ছন্দ। টানা ১৫ মিনিটের বেশি মনোনিবেশ করতে পারে না রীতম। কাজ বুঝে গেলে, ওই সময়ের মধ্যে দাঁড় করানোর ক্ষমতা রাখে ছেলেটা।”
রীতমের মনোরোগ চিকিৎসক প্রদীপ সাহার মতে, “ওঁর মস্তিষ্কের ডান দিক শক্তিশালী। তাই শিল্পীসত্তা রয়েছে রীতমের। পরিবারও ওকে এগোতে সাহায্য করছে। কারও এক দিক কমজোরি হলে, অন্য দিক শক্তিশালী হবেই। হতাশ না হয়ে সেটাই খুঁজতে হবে পরিবারকে। চিকিৎসা তো আছেই।”
পুজোয় কী করবে? পুজোর পরে সমুদ্র দেখতে যাব। খুব ভাল লাগে সমুদ্র। সেই ভাল লাগার টানেই রীতমের ১৮ বার পুরী ঘোরা হয়ে গিয়েছে।