আমাদের ছোটবেলায় বাঙালি পুরুষদের প্রধান পোশাক ছিল ধুতি-পাঞ্জাবি আর মেয়েদের শাড়ি-ব্লাউজ। বাবা-জ্যাঠাদের কেউ কেউ অবশ্য বাংলা শার্ট কিংবা ফতুয়াও পরতেন। ধুতির উপরে ধবধবে সাদা হাফশার্ট পরাটাও খুব বিরল ছিল না। দাদারা পরত পায়জামা-পাঞ্জাবি কিংবা ফুলপ্যান্ট-ফুলশার্ট। হাফশার্টের হাতার ঝুল হত কনুই পর্যন্ত আর একটু ঢিলেঢালা। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করত, তারা জনগণকে হাতের গুলি বোঝানোর জন্যে ফুলহাতা শার্টের হাতা অনেকটা গুটিয়ে রাখত আর দর্জিদাদাকে স্পেশাল ইনস্ট্রাকশন দিয়ে হাফশার্টের হাতার ঝুল বেশ খানিকটা কমিয়ে, একটু টাইট ফিট করিয়ে নিত।
জ্ঞান হওয়া ইস্তক মা-জেঠিমাদের আমি শাড়ি পরতেই দেখেছি। বাইরে বেরনোর সময় তাঁরা কুঁচি দিয়ে আর বাড়িতে থাকলে সামনে আঁচল করে শাড়ি পরতেন। সেই সব শাড়ির রং ছিল খুবই স্নিগ্ধ এবং সংযত। দিদিদের ফ্রকের পরে, সরাসরি শাড়ি পরতেই দেখেছি। ক্বচিৎ কখনও সালোয়ার কামিজ। দিদিদের শাড়ি হত উজ্জ্বল রঙের। কখনও সখনও তাতে রংচঙে প্রিন্টও থাকত। ব্লাউজ বানানোর জন্যে নামকরা কিছু দোকান ছিল। তারা পুজোর এক মাস আগে থেকেই জামা বানানোর অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিত। রাসবিহারীর কাছে এমন একটি দোকানের সামনে মহিলাদের রেলগাড়ির মতো লম্বা লাইন যাতায়াতের পথে আমি অনেক বার লক্ষ্য করেছি।
আরও পড়ুন: পুজোর শপিংয়ে গেলেন ঊষসী, কী কী বেছে নিলেন নিজের জন্য?
সেই সময়ে ব্রতপার্বণের দিনে বাড়ির মা-জেঠিমারা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে আমাদের ভবানীপুরের পাড়ার প্রাচীন মন্দিরে পুজো দিতে যেতেন। শাড়ির সাদা খোল, বেশিরভাগই হত গরদ বা তসরের। তাই সূর্যের আলো পড়লে তা ঝকঝক করত। তাঁরা তখন ঘোমটা ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরতেন না। তাই তাঁদের মুখের চারপাশে ওই লাল রঙের পাড়, কপালের লাল সিঁদুর এবং গোলালো টিপ এক আশ্চর্য মায়াময় ছবি তৈরি করত। সেই শাড়ির আঁচলের খুঁটে বাঁধা থাকত সামান্য কিছু পয়সা, যা দিয়ে তাঁরা মোড়ের দোকান থেকে ক্ষীরের গুজিয়া, প্যাঁড়া কিংবা চন্দনের গন্ধওয়ালা ধূপ কিনতেন। পাড়ার পশ্চিম প্রান্তে মুখার্জি ঘাট দুর্গা মণ্ডপে অঞ্জলি দিতেও যেতেন ওই শাড়িটি পরে। পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে, যে পঞ্চপ্রদীপে দেবীকে আরতি করা হয়েছে, তা অঞ্জলি দিতে আসা ভক্তদের দিকে পুরোহিত মশায়ের কোনও সহকারী বাড়িয়ে ধরলে, তার উপরে নিজের ডান হাতের তালু নিয়ে গিয়ে তার পবিত্র উত্তাপ নিতেন। তার পর সেই হাত ছোঁয়াতেন নিজের কপালে ও বুকে। এর পরে, লাল পাড় সাদা শাড়ির আঁচলের একটি কোণ, চট করে সেই প্রদীপের উপরে এনে, সেই পবিত্র উত্তাপ ভরে নিয়ে, তাতে একটি গেঁট বেঁধে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতেন। এসে, সেই গেঁট খুলে, আঁচলের কোণটি মুঠো করে ধরে, আমাদের মতো কুচোকাঁচাদের মাথায়, বুকে আলতো করে বুলিয়ে দিতেন। মণ্ডপে যেতে পারিনি বলে, আমরা সেই পবিত্র উত্তাপ থেকে বঞ্চিত হব—এটা তাঁরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারতেন না। এই ভাবে ধর্মকে বাহন করে অনেকটা স্নেহ ও ভালবাসা অজান্তেই ঝরে পড়ত আমাদের ওপর।
এই ভাবে প্রদীপ দিয়ে মা দুগ্গার আরতি করলে কী হয়?
খুব ছোট যখন, বিভিন্ন সময়ে আমার চার জেঠিমা কিংবা মায়ের কাছে প্রশ্ন করেছি, এই ভাবে প্রদীপ দিয়ে মা দুগ্গার আরতি করলে কী হয়? উত্তর এসেছে, মনের অন্ধকার দূর হয়। প্রশ্ন করেছি, মনের অন্ধকার মানে কী? উত্তর এসেছে, মনের মধ্যে যত খারাপ ইচ্ছে, যেমন লেখাপড়া করব না, সারা দুপুর না-ঘুমিয়ে দুষ্টুমি করব, খাওয়ার সময়ে ডাল-ভাত না খেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আচার কিংবা কনডেন্সড মিল্ক খাব—এগুলোই হল মনের অন্ধকার। এ বার আমার প্রশ্ন, মা দুগ্গাকে অত কিছু দিয়ে আরতি করা হয় কেন? উত্তর এসেছিল, দেবীকে ফুল দিয়ে আরতি করলে, মানুষের মন ফুলের মতো সুন্দর হয়ে ওঠে। ধূপ দিয়ে আরতি করলে হৃদয় সুগন্ধে ভরে ওঠে আর মানুষের সুনাম ধূপের সুগন্ধের মতো বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। শঙ্খ দিয়ে আরতি করলে মানুষের দেহ রোগমুক্ত হয়। নতুন বস্ত্র দিয়ে আরতি করলে মানুষের মন সব সময়ে নতুন জামা-কাপড় পরার মতো আনন্দে ভরে থাকে। কোনও দিন তার জামাকাপড়ের অভাব হয় না। এই উত্তরগুলোর সবক’টা যে সেই বালক বয়সে পরিষ্কার বুঝতাম, তা হয়তো নয়। কিন্তু প্রতিটি উত্তরের মধ্যে যেহেতু সবার ভাল থাকার, সুস্থ থাকার, আনন্দে থাকার একটা ব্যাপার ছিল—তাই শুনতে ভারি ভাল লাগত। অনেক পরে বুঝতে পেরেছি, দেবীর কাছে এই চরাচরের সব মানুষকে ভাল রাখার আবেদন জানানোর প্রপার ফরম্যাটটির নামই হল আরতি। নতুন জ্যাঠার কাছে আমার এ বিষয়ের শেষ প্রশ্নটি ছিল, মাঝে মাঝে দেবীর সামনে নেচে নেচে আরতি করা হয় কেন? উত্তর এসেছিল, এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে, একই জিনিস বার বার শুনতে শুনতে আমাদের যেমন ক্লান্ত লাগে, দেবীও তেমনই বোর হয়ে যান। তাঁকে আমাদের আবেদন একটু নতুন ভাবে না শোনালে, তিনি আর তা শোনার উৎসাহ পান না। তাই ঢাকের তালে তালে, নেচে নেচে আরতি করলে, তিনি আবার আমাদের দিকে হাই তুলতে তুলতে একটু ফিরে দেখেন এবং আমাদের মনের কথা শোনেন।
আরও পড়ুন: অষ্টমীতে যে মেয়ের সঙ্গে আইসক্রিম খাওয়ার কথা, মাস্ক পরা এ সে তো
অঞ্জলি দেওয়ার সময়ে নৈবেদ্যর সঙ্গে, একটি লালপাড় সাদা শাড়িও দেওয়া হত মা দুগ্গার জন্যে—এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। তাহলে যত ঝকমকে শাড়ি-জামাই পরুন না কেন, উনিও মনে মনে ওই ধরনের শাড়িই বেশি পছন্দ করতেন। আসলে সেই সময়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি ফ্যাশনের একটা দুর্ধর্ষ প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এক জন নারী, সে ওই শাড়িটি গায়ে জড়িয়ে এক মুহূর্তে মা হয়ে উঠছে, মোহময়ী হয়ে উঠছে, এমনকি কমবয়সি মেয়েরাও যখন এটা পরছে, তখন তাদের আশ্চর্য রকম সুন্দর লাগছে। মায়াময় লাগছে। এই শাড়িতে বোধহয় এক জন নারীর পুরো ডায়মেনশনটাই এক লহমায় বদলে যায়। সে হয়ে ওঠে তুলনাহীন এবং অনন্য। সে একাধারে হয়ে ওঠে শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক এবং আমাদের ঘরের মেয়ে—সত্যি সত্যিই যা হয়ে ওঠা কিন্তু খুব সোজা কথা নয়!
কার্টুন: দেবাশীষ দেব।