Durga Puja 2020

মা দুগ্গা আসবেন, তাই ঝেড়েপুঁছে সেজে উঠত ঘরদোর

এই যে এত ঝাড়াঝুড়ি, রংচঙ করা—এ তো সবই ঘরদোরের সঙ্গে মনের ময়লাকেও সাফ করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নেওয়ার একটা ছুতো মাত্র। 

Advertisement

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২০ ১৫:০৭
Share:

পুজোর আগে ঘর সাজানো আর ঘর গোছানো বাঙালি গেরস্তর বহু দিনের অভ্যেস। এই সময়ে ধুলো-ময়লা সাফ করে ঘরদোর তকতকে না করে রাখলে মা দুগ্গা এসে কোথায়ই বা দাঁড়াবেন, আর কোথায়ই বা বসবেন। ছেলেবেলায় তাঁর এই আসাটাকে এত স্বাভাবিকভাবে এবং এতটাই দরদ দিয়ে বলা হত যে, আমার মতো ছোটরা ধরেই নিতাম, পুজোর সময়ে মা দুগ্গা নিশ্চয়ই আমাদের সবার বাড়িতে এক বার না এক বার দেখা করতে আসেন। হয়তো বা একটু বেশি রাতে আসেন, যখন আমরা ঠাকুর দেখে ক্লান্ত হয়ে ফিরে, লুচি আর সাদা ছেঁচকি খেয়ে কাদা হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। তাই আমাদের সঙ্গে একটুর জন্যে তাঁর দেখা হয় না।

Advertisement

তখন ঘর ঝাড়ার শুরু হত প্রধানত ঝুলঝাড়ু দিয়ে। সে সময়ে কিন্তু হাল আমলের মতো ফাইবারের ডান্ডার মাথায় নাইলনের ঝালর আটকানো ঝুলঝাড়ু মোটেই ছিল না। সাবেক ঝুলঝাড়ুর লম্বা সরু বাঁশটির মাথায় প্রায় ফুটখানেক জায়গা জুড়ে, পাটের গুছি কেটে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে, সুতো বা তার দিয়ে জড়িয়ে বাঁধা থাকত। ঝুলঝাড়ু যেহেতু ফুলঝাড়ুর বড়দা, তাই সে অন্য সব ঝাড়ুর থেকে ছিল লম্বা। তাই ঘরের উঁচু জায়গার ঝুল সাফ করা ছাড়াও তার একটি সামাজিক দায়িত্ব ছিল। আর সেটা হল- কেটে যাওয়া বা পাশের বাড়ির পাঁচিল থেকে ঝুলে থাকা পরিত্যক্ত ঘুড়িদের ঠিকনি রোদের দুপুরে নিরাপদে উদ্ধার করে আনা। এই জন্যে ঝুলঝাড়ুদের কখনও কখনও ডান্ডা জখম বা চুল কিঞ্চিৎ উঠে যাওয়া অবস্থায়, বাড়ির কোনও পরিত্যক্ত অঞ্চল থেকে খুঁজে পাওয়া যেত।

ঝুল ঝাড়ার সময়ে সবাই কাজ করতেন নাকে রুমাল বা গামছা জড়িয়ে। ফলে মনে হত, ঘরে যেন এক দল দস্যু ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি নিজে তখন ঝাড়াঝুড়ির কোনও কাজ না করলেও, মাঝে মাঝে নাকে একটা রুমাল বেঁধে জ্যাঠা-জ্যাঠাইমাদের ঘরে সেঁধিয়ে পড়ার চেষ্টা করতাম এবং কেউ দেখতে পেলেই একখানা রামবকুনি খেয়ে চুপচাপ বেরিয়ে আসতাম।

Advertisement

আরও পড়ুন: পুজোর হাওয়া আর পোড়-খাওয়া চিরকুটের গল্প

কিন্তু ঝুলঝাড়ু দিয়ে ঘরের টঙের ঝুল ঝাড়া গেলেও, পাখার তিনটে ব্লেডে লেগে থাকা কালচে ময়লা বা কাচের ডুমের শেডের গায়ে আটকে থাকা পুরু ধুলো পরিষ্কার করা সম্ভব হত না। এ জন্যে একখানা কাঠের চেয়ার বা টুল খাটের ওপর তুলে, তার উপরে ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে, কিংবা ঘড়িঞ্চিতে উঠে, হাতে একখানা পুরনো ছেঁড়া গেঞ্জির কাপড় দিয়ে সেগুলো মুছে ঝকঝকে করতে হত। ঝাড়াঝুড়ির পর তা মুছে দেওয়া হত সাবান জলে ভেজানো ন্যাকড়ায় করে। এর পরে শুরু হত দেওয়াল আলমারি আর দেরাজ ঝাড়পোঁছ করার পালা। পোকামাকড়, টিকটিকি, আরশোলা—যারা সেগুলোর আনাচে কানাচে একটু নিভৃত ঘরগেরস্থালি পেতেছিল, সেখান থেকে তাদের বিদায় করা।—

তখন ঘর ঝাড়ার শুরু হত প্রধানত ঝুলঝাড়ু দিয়ে।

আগে যৌথ পরিবারে সব শরিকদের ঘরেই একটি করে ঠাকুরের তাক থাকত। যেখানে ঠাকুর দেবতারা মহানন্দে আত্মীয় পরিজন নিয়ে শোভা পেতেন। জল-বাতাসা এবং নকুলদানা পেতেন। কোথাও সেটা কাঠের তক্তা দিয়ে, আবার কোথাও কুলুঙ্গির মধ্যে বেশ কায়দা করে বানানো থাকত। সেই পবিত্র জায়গাটিকে মন চাইলেই তো আর ঝেড়ে-ঝুড়ে পরিষ্কার করা যেত না। সাবধানে সেখানে জমে থাকা শুকনো দুব্বো, বেলপাতা, তুলসীপাতা, এক-আধটা মলিন ফুলের পাপড়ি, একটি পরিচ্ছন্ন কাপড়ের ভিতরে মুড়িয়ে, মাটিতে এককুচিও না-ফেলে, সাবধানে সরিয়ে নেওয়া হত, যাতে পরে তা গঙ্গায় বা কোনও পরিচ্ছন্ন জলাশয়ে বিসর্জন দিয়ে দেওয়া যায়। এই সময়ে প্রতিটি ঠাকুরের আসন এবং বাইরে থেকে ঝোলানো পর্দাটিও বদলে ফেলা হত। বদলানো হত ঠাকুরের জামা, গয়না, মুকুট এবং তাকিয়ার খোল। তাঁরা যদি তামা বা পেতলের আসনে বসতেন, তবে সেটিও তেঁতুল দিয়ে রগড়ে মেজে ঝকঝকে করে দেওয়া হত।

আরও পড়ুন: পুজোর আনন্দের মধ্যেই ছিল পরীক্ষার ভয়ের কাঁটা

আগে মানুষ যখন মাটির বাড়িতে থাকত, তখন সেই বাড়িও নিকোনো হত পুজোর আগে-আগেই। বর্ষা চলে যেত বলে চালের খড়ও বদল করা হত। বাড়ির চারধারে নষ্ট হয়ে যাওয়া রাংচিতার বেড়া আবার সুন্দর ভাবে বসিয়ে নেওয়া হত। যাদের পাকা বাড়ি ছিল, তারা চুন-সুরকির দেওয়ালের পুরনো পলেস্তরা ছাড়িয়ে, ফাটা-চটা বুজিয়ে, মলিন হয়ে আসা রং ঘষে-মেজে করে ফেলত ঝকঝকে নতুন। আগে রং বলতে ছিল শক্ত সাদা চুন, যাকে লোহার বালতিতে ঢেলে জলের সঙ্গে ভিজিয়ে রাখতে হত সারা রাত। এর মধ্যে কিছুটা শিরীষের আঠাও মিশিয়ে দেওয়া হত। পরের দিকে দেখেছি, সাদার বদলে কেউ ঘরে অন্য কোনও রং করতে চাইলে সকালবেলা কাজ শুরুর আগে চুনের মধ্যে সেই নীল বা হলুদ রঙের গুঁড়ো মিশিয়ে দেওয়া হত। তার পর পাটের তৈরি পোঁছড়ায় করে সেই চুনে মেশানো রং দেওয়ালে বুলিয়ে দেওয়া হত। রাত্তিরে ভেজানোর সময়ে ঠান্ডা জলে চুন ফেললে সঙ্গে সঙ্গে তা বগবগ করে ফুটতে শুরু করত। তখন বালতির গায়ে হাত দিলে ছ্যাঁকা মারার মতো গরম টের পেতাম। সারা রাত সেই ভেজানো চুনের মধ্যে থেকে সিঁইইইই গোছের একটা শব্দ শুনতে পাওয়া যেত। সব অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরে রেডিও বন্ধ করতে ভুলে গেলে, তার বুকের অনেক ভেতর থেকে যে অসহায় বেদনামাখা অতি মৃদু পিঁইইইই শব্দটি ভেসে আসত—এ যেন অনেকটা তার বোনের চাপা কান্নার মতো!

ঘর রং করার পাশাপাশি চলত জানলা-দরজা রং করার কাজ। এর জন্য অবশ্য আলাদা একটা দল কাজ করত। লোহার গরাদে রং করা হত একখানা কাপড়কে তেলরঙের কৌটোয় ডুবিয়ে ডুবিয়ে। জানলা-দরজার পাল্লাতেও বুরুশে করে দেওয়া হত তেলরং। আগে লোহার গরাদ কালো আর পাল্লা টিয়াসবুজ করার একটা চল ছিল। এই রং শুকোতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগত। এই সময়ে কাঁচা রঙে জামা ঘষে গেলে, কেরোসিন তেল না রগড়ালে সেই রং উঠতে চাইত না। কিছুদিন পুরনো হয়ে আসা পাল্লার রঙের ওপরে নিজের হাতের চেটো জোরে চেপে ধরে টেনে তুলে নেওয়ার সময়ে একটা আঠার মতো টান বুঝতে পারা যেত। এটা ছিল একটা প্রিয় খেলা।

আরও পড়ুন: মিষ্টি হেসে বলল... হ্যাপি পুজা!

এ ভাবেই পুজোর আগে নতুন বিছানার চাদর কেনা হত। বালিশে পরানো হত নতুন ওয়াড়। প্রিয় রেডিওটিকেও করে দেওয়া হত ছিটের একটি ঢাকনা-জামা। আসলে এই যে এত ঝাড়াঝুড়ি, রংচঙ করা—এ তো সবই ঘরদোরের সঙ্গে মনের ময়লাকেও সাফ করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নেওয়ার একটা ছুতো মাত্র। মা আসছেন। মনটাকেই যদি সবার আগে পরিষ্কার না করি, তবে তাঁকে বরণ করে নেব কী দিয়ে?

কার্টুন : দেবাশীষ দেব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement