দুর্গাপুজো নিয়ে লিখতে বললেই তো ছোটবেলার গল্প মনে এসে ভিড় করে। কিন্তু সে ছোটবেলার গল্প তো সবাই লিখছে। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে দুর্গাপুজোর কত আগে থেকে নানান স্মৃতিকথা পড়ছি। কেউ কেউ ছবি-সহ পোস্ট দিয়েছেন: আশ্বিনের রোদ খাওয়াচ্ছেন আলমারিতে বন্ধ পড়ে থাকা জামাকাপড়কে। কেউ কেউ ক’টা শাড়ি হল তার পোস্ট দেন, কেউ লেখেন কোথায় বেড়াতে যাচ্ছেন। আমাদের একটা মেয়েদের ফেসবুক গ্রুপে আমরা আলোচনা করলাম এই পুজোর দেওয়া-থোওয়া নিয়ে। কত কথা উঠে এল। বাঙালির দুর্গাপুজো তো আসলে পরিবারে পরিবারে সব বয়সি মেয়েদেরই বন্দনা। তাদেরই আদর, তাদেরই আহ্বান। আমি এ রকম ভাবে দেখি। পুরুষদের ভূমিকাটা অনেকটা কার্যকর্তাদের মত। কিন্তু কাদের ঘিরে এত আয়োজন? এই নারী সমাজকে ঘিরেই। মঞ্চে যিনি উপবিষ্ট তিনিও নারী। তাঁকে ঘিরে উৎসব। আর উৎসবের কেন্দ্রে তাঁকে রেখে রক্তমাংসের নারীদেরই বন্দনা করা। এখানে বন্দনা মানে ‘প্যামপার’ ধরতে হবে। ফলে কেনাকাটা মেয়েদেরই বেশি। উপহারের আশি শতাংশ মেয়েদের কপালেই জোটে। বস্তুত, আমাদের নারী-পুরুষের যুগ্ম সমাজ থেকে মেয়েদের উপস্থিতি সরিয়ে নিলে আলো ঝলমলে আনন্দের পরিবেশ বলে আর কিছু থাকে না। এই আনন্দই তো দুর্গাপুজোর আসল উপাচার, যা দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে এগিয়ে যাই। এই করতে করতে এসে যায় মহালয়া আর আমাদের দুর্গাপুজো শুরু হয়ে যায়। দেবীপক্ষ শুরু হয়ে যায়।
বাঙালির জীবনের একটা অদ্ভুত দিক আছে। এক জন বাঙালির জীবনটা কেমন চলছে, কেমন কাটছে, দুর্গাপুজো এলে তার একটা পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়। কোন মানসিক, আর্থিক, শারীরিক, পারিবারিক অবস্থায় এক জন বাঙালি রয়েছে তা বোঝা যায় দুর্গাপুজোর সময়। এই সব কিছু যদি মোটামুটি ঠিকঠাক থাকে তা হলে বাঙালি দুর্গাপুজোর ঢালাও আনন্দের স্রোতে এলোপাথাড়ি হাত পা ছুড়বেই। সাজবে, গুজবে, হ্যা, হ্যা করে হাসবে, যা জীবনে খেয়ে হজম করতে পারে না দলে পড়ে তাই খাবে, খেয়ে রাতে গলা বুক জ্বলা নিয়ে ছটফট করবে, যতটা হাঁটলে পায়ের কলকব্জা খুলে যায় ততটা হাঁটবে, দু’মাইল লাইনে দাঁড়িয়ে ঠিক মণ্ডপের সামনে পৌঁছে বলবে, ‘‘এ বার আমি অজ্ঞান হয়ে যাব, আমার আর ঠাকুর দেখে কাজ নেই, চল বাবা ফিরে যাই, মানুষ আসে এই ভিড়ে?’’ কানমূলে বলবে, ‘‘এই শেষ, আর জীবনেও আসছি না।’’ বলে আবার পরের দিন বেরবে আরও সেজেগুজে, আরও নানান খাবারের চিন্তা মাথায় নিয়ে। বেরিয়ে দু’ঘণ্টা ট্রাফিকে আটকে বসে বলবে, ‘‘এত মানুষ বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়? ভগবান, লক্ষ লক্ষ মানুষ।’’ ভুলে যাবে এই প্রচন্ড দমবন্ধ করা ভিড়ে সে বাল-বাচ্চা, বেতো দিদিমা, হেঁপো দাদু সমেত নিজেও একটা সংযোজন।
আরও পড়ুন: বদলে গেছে পুজোর রং, আমার বুকে আজ আর তোলপাড় নেই: অর্পিতা
ওই যে বললাম, এক জন কেমন আছে সেটা তার দুর্গাপুজো পালন দেখলেই ধরে ফেলা যায়। মানুষ যখন ব্যক্তিজীবনে তীব্র নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তখন তার দুর্গাপুজো কাটে একেবারে অসামাজিক ভাবে। হয়ত টাকাপয়সা অত নেই, কিন্তু ভেতরে একটা নিরাপত্তার শক্তপোক্ত বোধ আছে, সে কিন্তু খুব আনন্দ করে দুর্গাপুজো করবে। আমাদের পুরনো পাড়ায় পালিঠাকুমা বলে এক জন ছিলেন। তাঁর কেউ ছিল না। বিধবা, নিঃসন্তান। পাঁচিল ঘেরা বাড়িতে একা থাকতেন। সাদা থান পরতেন। নিরাভরণ। খালি পায়ে হেঁটে চলে বেড়াতেন যত্রতত্র। এই মানুষটার যে কোন পর্যায়ে সামাজিক ইনভলভমেন্ট ছিল ভাবা যায় না! দুর্গাপুজোর সময় গরিবগুর্বোকে ডেকে এনে পেট ভরে ভোগ খাইয়ে, সেই এঁটো শালপাতা ফেলানোর তদ্বির তদারকিতেও তো তাঁর পাঁচ দিন হইহই করে কেটে যেত। আবার এ রকম মানুষ দেখেছি, ছেলে আমেরিকায় চলে গেছে, আসে না, পুরো পুজো তাদের সমস্ত বাড়ি অন্ধকার। কেউ ডাকলেও বেরয় না। সারা বছর যে শোক চোখে দেখা যায় না, দুর্গাপুজোর সময় সেই শোক প্রকট হয়ে ধরা পড়ে।
আমার যেমন কখনও পুজো ভাল কেটেছে, কখনও খুব খারাপ। গত দু’বছর খুব ভাল কাটিয়েছি। খেয়েদেয়ে, সারারাত ঠাকুর দেখে, সেজেগুজে, হুল্লোড় যা করেছি জীবনে এত আনন্দ করিনি কোনও পুজোয়। আমার আর আমার বরের কমন বন্ধু, লুৎফুন্নেসা আর ওর বর গত দু’বছর আমাদের সঙ্গে পুজোয় খুব আনন্দ করে গেছে বাংলাদেশ থেকে এসে। দশমীর বিকেলে বিসর্জনের দিন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছি ঠাকুর পরিক্রমা। সমস্ত কমপ্লেক্স ঘোরানো হচ্ছে মা’কে। ঢাক বাজছে। সবাই ধুনুচি নাচ নাচছে। আর একটা চক্কর, তার পরই মা বিদায় নিয়ে চলে যাবেন এই কমপ্লেক্সের মানুষদের থেকে। লুৎফুন্নেসা আমার পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। হঠাৎ আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, ওমা, ওর চোখ ছলছল করছে, অপরূপ সৌন্দর্য সেই মুখে, শুধু ত্রিনয়নটাই নেই! আমি কিছু বলার আগেই ও বলল, ‘‘কাল তো আমিও চলে যাব আপু।’’
আরও পড়ুন: বাবার মলিন, ক্লান্ত ঝোলায় আমার ছোটবেলার পুজোটা ছিল: শ্রীজাত
এমনিই আমি ওকে সন্তানতুল্য স্নেহ করি। চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি, আদর করে জড়িয়ে ধরে একটাই কথা বলেছিলাম, ‘‘আসছে বছর আবার আসবি মা।’’ যা আমরা বলি মা দুর্গাকে বিদায় জানানোর সময়, যা আমরা বলি বাড়ির মেয়েকে বিদায় জানানোর সময়। হতে পারে মা দুর্গা হিন্দু দেবী, কিন্তু তাঁর মধ্যে যে মেয়েকে, যে মাকে আমরা প্রতি মুহূর্তে দেখতে পাই, অনুভব করতে পারি, আরাধনা করি, তার তো কোনও ধর্ম হয় না!
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস