১৯০৫ সালে আজকের দিনের উত্তর কলকাতার আহিরীটোলায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম। বাবা রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র পেশায় ভাষাতত্ত্ববিদ। মা সরলা দেবী।
ঠাকুরমা যোগমায়া দেবীর কাছে তিনি ছোটবেলাতেই সংস্কৃত শিক্ষা পেয়েছিলেন৷ প্রখর স্মৃতিধর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মাত্র আট বছর বয়সে চণ্ডীপাঠ করে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই অনায়াসে চল্লিশ-পঞ্চাশ পাতার কবিতা মুখস্থ করে অনর্গল বলতে পারতেন। ঠাকুরমা শেক্সপিয়ার ও গিরিশ্চন্দ্র ঘোষের নাটক পাঠ করে শোনাতেন তাঁকে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২৮-এ। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের সদর দফতরে।
চাকরি করলেও তাঁর মন পড়ে থাকত ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে। টিফিনের সময়ে কিংবা বিকেলে ছুটির পরে তাই প্রায়ই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ পৌঁছে যেতেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর বন্ধুদের আড্ডায়। এই আসর থেকেই ধীরে ধীরে এল বেতারে নাটকের সুযোগ।
আকাশবাণীর দফতরে যোগ দিলেন তিনি। তার পর থেকেই দুর্গাপুজা উপলক্ষে দেবী দুর্গার অসুরদমনের কাহিনি অবলম্বনে দু'ঘণ্টার সঙ্গীতালেখ্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।
এই অনুষ্ঠানটির ভাষ্য লিখেছিলেন বাণীকুমার ভট্টাচার্য। সঙ্গীত পরিচালনায় রাইচাঁদ বড়াল এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক।
প্রথম দিকে টেপরেকর্ডিং করা অনুষ্ঠানের চল ছিল না। আকাশবাণী-তে সব অনুষ্ঠানই তখন সরাসরি সম্প্রচারিত হত।
‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে যাঁরা অংশ নিতেন, তাঁরা অনেকেই অনুষ্ঠানের আগে আসতেন। কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আগের রাত থেকেই রেডিও স্টেশনে। ভোরে অনুষ্ঠান শুরুর আগে স্নান করে গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে চণ্ডীপাঠে বসতেন তিনি।
একদিন স্টুডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর নিজস্ব ধারায় সুরেলা কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ করছিলেন। হঠাৎই রসিকতার ছলে বাংলা ভাষ্যটিও স্তোত্রের সুরের অনুকরণে বলা শুরু করেন।
বাণীকুমারের নজরে আসতেই তিনি তৎক্ষণাৎ সেই স্তোত্রপাঠ রেকর্ড করার পরামর্শ দেন। তার পর বাকিটা ইতিহাস।
সেইদিন থেকেই আকাশবাণীতে শুরু হল মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ। রেডিওর জন্য নিবেদিত প্রাণ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র সারা দেশ তথা পৃথিবী জুড়ে মহালয়ার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে পড়লেন চিরকালের মতো।
১৯৭৬ সালে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন, চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ উত্তমকুমারকে দিয়ে করাবেন। বাদ পড়লেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। সেই অনুষ্ঠান চরম ব্যর্থ হল। বেতার অফিস ভাঙচুর পর্যন্ত হয়েছিল! শেষপর্যন্ত শ্রোতাদের চাহিদা মেনে সে বছরই ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার করা হয়। এ নিয়ে কোনও ক্ষোভ বা অভিমান তিনি মনে রাখেননি।
১৯৯১ সালের ৩ নভেম্বর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মৃত্যু হয়। তবে মহালয়ার ভোরে বাঙালির মনের খোরাক হয়ে আজও বেঁচে রয়েছেন তিনি।