‘ওঁ খড়্গং চক্রগদেষুচাপপরিঘান শূলং ভুশুণ্ডীং শিরঃ| শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গভূষাবৃতাম্ || নীলাশ্মদ্যুতিমাস্যপাদদশকাং সেবে মহাকালিকাম্ | যামস্তৌৎ স্বপিতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্ ||’ – মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর শ্রী শ্রী মহাকালীর ধ্যানমন্ত্রে পাওয়া যায়। তিনি দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। শাক্ত মতে, কালীই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেছেন। কালী সেই আদি শক্তিরই মূর্ত রূপ। কিন্তু আজকের এই কালী বা শ্যামা মূর্তি কিন্তু খুব প্রাচীন নয়। কথিত আছে, ষোড়শ শতকের তন্ত্র সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশই প্রথম কালীর রূপ কল্পনা করেছিলেন। তার আগে দেবী পূজিতা হতেন ‘যন্ত্রে’। এছাড়াও গুহ্য মূর্তি শবশিবা বা অন্য কল্পে দেবী পূজিতা হতেন। দেবীর সেই রূপ গৃহী ভক্তদের উপযোগী নয় ভেবে কৃষ্ণানন্দ সেই রূপে বদল আনেন। দেবীপুরাণ, দেবীমাহাত্ম্য, কালিকাপুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থগুলিতে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। সাধারণভাবে দেবী চতুর্ভুজা, তাঁর মূর্তিতে চারটি হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্নমুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা, গলায় মুণ্ডমালা, লোলজ্বিহা, বক্রনয়না, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ (মতান্তরে নীল), এলোকেশ দেখা যায়। মহাদেবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। নানা রূপে দেবীর আরাধনা করা হয়। যেমন – দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। আবার বিভিন্ন মন্দিরে ‘ব্রহ্মময়ী’, ‘ভবতারিণী’, ‘আনন্দময়ী’, ‘করুণাময়ী’ ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা ও পূজা করা হয়। তোড়ল তন্ত্র মতে কালী অষ্টধা বা অষ্টবিধ। অর্থাৎ তাঁর আটটি রূপ আছে, যথা – দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী ও শ্রীকালী। মহাকাল সংহিতা অনুসারে আবার কালী নববিধা। এই তালিকা থেকেই পাওয়া যায় কালকালী, কামকলাকালী, ধনদাকালী ও চণ্ডিকাকালী ইত্যাদি নাম।
দক্ষিণাকালী: দেবীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ মূর্তি দক্ষিণাকালী। বলা হয়, দক্ষিণদিকের অধিপতি যম যে কালীর ভয়ে পলায়ন করেন, তিনিই দক্ষিণাকালী। দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তাঁর বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ, দক্ষিণকরের একটিতে বর ও অপরটিতে অভয় মুদ্রা। তাঁর গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়, তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী। দেবীর দক্ষিণপদ মহাদেবের বক্ষে স্থাপিত।
সিদ্ধকালী: গৃহস্থের বাড়িতে সিদ্ধকালীর পূজা হয় না। তিনি মূলত সিদ্ধ সাধকদের ধ্যান আরাধ্যা। কালীতন্ত্রে দেবীকে দ্বিভুজা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। অন্যত্র তিনি ব্রহ্মরূপা ভুবনেশ্বরী। তাঁর মূর্তির দক্ষিণহস্তে ধৃত খড়্গের আঘাতে চন্দ্রমণ্ডল থেকে অমৃত রস নিঃসৃত হয়, সেই অমৃত রস বামহস্তের কপালপাত্রে ধারণ করে পরমানন্দে পান করেন দেবী। তিনি সালংকারা। তাঁর দক্ষিণপদ শিবের বুকে ও বামপদ শিবের উরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে সংস্থাপিত।
গুহ্যকালী: গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ গৃহস্থের কাছে অপ্রকাশ্য। তিনি সাধকদের আরাধ্যা। তাঁর রূপকল্প ভয়ংকর, গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়। লোলজিহ্বা ও দ্বিভুজা দেবীর গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা, কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র, স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র, কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার। চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা দেবীর বাম কঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ, বামে বৎসরূপী শিব। তিনি নবরত্নভূষিতা, অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন। মহাকাল সংহিতা মতে, নববিধা কালীর মধ্যে গুহ্যকালীই সর্বপ্রধানা। তাঁর মন্ত্র বহু – প্রায় আঠারো প্রকারের।
মহাকালী: তন্ত্রসার গ্রন্থমতে, মহাকালী পঞ্চবক্ত্রা ও পঞ্চদশনয়না। তবে কালিকাপুরাণে তাঁকে আদ্যাশক্তি, দশবক্ত্রা, দশভূজা, দশপাদা ও ত্রিংশল্লোচনা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁর দশ হাতে রয়েছে যথাক্রমে খড়্গ, চক্র, গদা, ধনুক, বাণ, পরিঘ, শূল, ভুশুণ্ডী, নরমুণ্ড ও শঙ্খ। ইনিও ভৈরবী, তবে গুহ্যকালীর সঙ্গে এঁর পার্থক্য রয়েছে। ইনি সাধনপর্বে ভক্তকে উৎকট ভীতি প্রদর্শন করলেও অন্তে ভক্তকে কাঙ্খিত ফল প্রদান করেন।
ভদ্রকালী: এখানে ভদ্র শব্দের অর্থ কল্যাণ এবং কাল শব্দের অর্থ শেষ সময়। যিনি মৃত্যুকালে জীবের মঙ্গলবিধান করেন, তিনিই ভদ্রকালী। কালিকাপুরাণ মতে, ভদ্রকালীর গাত্রবর্ণ অতসীপুষ্পের ন্যায়, মাথায় জটা, ললাটে অর্ধচন্দ্র তন্ত্র মতে অবশ্য তিনি মসীর ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা, কোটরাক্ষী, সর্বদা ক্ষুধিতা, মুক্তকেশী। তিনি জগৎকে গ্রাস করছেন, তাঁর হাতে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ও পাশযুগ্ম। সকল ‘অবিদ্যা’-র দেবী তিনি।
চামুণ্ডাকালী বা চামুণ্ডা: দেবীভাগবত পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে, চণ্ড ও মুণ্ড নামক দুই অসুর বধের নিমিত্ত দেবী দুর্গার ভ্রুকুটিকুটিল ললাট থেকে চামুণ্ডার উৎপত্তি। অস্থিচর্মসার বিকটদন্ত দেবীর হস্তে অস্ত্র, দণ্ড ও চন্দ্রহাস, পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম। দুর্গাপুজোর মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে আয়োজিত সন্ধিপুজোর সময় দেবী চামুণ্ডার পুজো হয়। অগ্নিপুরাণ-এ আট প্রকার চামুণ্ডার কথা বলা হয়েছে। তাঁর মন্ত্রও অনেক।
শ্মশানকালী: কালীর এই রূপকে শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনে করা হয়। তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ রচিত বৃহৎ তন্ত্রসার অনুসারে এই দেবীর গায়ের রং কাজলের মতো কালো, চোখদুটি রক্তপিঙ্গল বর্ণের, আলুলায়িত কেশ, দেহ শুকনো ও ভয়ঙ্কর, তাঁর ডান হাতে সদ্য ছিন্ন নরমুণ্ড, বাঁ-হাতে আসবপূর্ণ নরমুণ্ড নির্মিত পানপাত্র। শ্মশানকালীর আরেকটি রূপে তাঁর বাঁ-পা শিবের বুকে স্থাপিত এবং ডান হাতে ধরা খড়্গ। এই রূপটিও ভয়ংকর। গৃহস্থবাড়িতে বা পাড়ায় সর্বজনীনভাবে শ্মশানকালীর পূজা হয় না। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, শ্মশানকালীর ছবিও গৃহস্থের বাড়িতে রাখা উচিত নয়।
শ্রীকালী: দেবীর আরেক রূপ শ্রীকালী। অনেকের মতে এই রূপে তিনি দারুক নামক অসুর নাশ করেন। দেবী মহাদেবের শরীরে প্রবেশ করে তাঁর কণ্ঠের বিষে কৃষ্ণবর্ণা হন এবং পরবর্তীকালে মহাদেব শিশুরূপে তাঁর স্তন্যপান করেন। শিবের ন্যায় ইনিও ত্রিশূলধারিনী ও সর্পযুক্তা।
আদ্যাকালী: মহানির্বাণ তন্ত্রে এই দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। আদ্যাকালীর রং মেঘের মতো ঘন নীল, কপালে চন্দ্ররেখা, ত্রিনেত্রা, রক্তবস্ত্র পরিধানে থাকে। প্রস্ফুটিত রক্তপদ্মে দেবী আসীনা, পুষ্পের মিষ্টি সুধা পান করে সম্মুখে নৃত্যরত মহাকালের নৃত্য দর্শন করে আনন্দিতা তিনি।
রক্ষাকালী: রক্ষাকালীকে দক্ষিণাকালীরই একটি নাগরিক রূপ হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন কালে নগর বা লোকালয়ের রক্ষার জন্য এই দেবীর পুজো করা হতো। দেবীর পূজা মন্ত্রও ভিন্ন। স্থানভেদে রক্ষাকালীর বাহন সিংহ। মহাকাল সংহিতায় দেবী কালিকার নয়টি রূপের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থে দেবীর ১৩টি রূপের সন্ধান মেলে। সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নি রুদ্রকালী, মহাকালী, ঘোরচণ্ডকালী, মহাভৈরবকালী। এছাড়াও আছেন, ডম্বরকালী, ইন্দিবরকালী, বামাকালী, হংসকালী, শ্যামাকালী, পার্বতীকালী, রটন্তীকালী, ফলহারিণী কালী, নিত্যকালী, ঈশানকালী, জীবকালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী ইত্যাদি। ‘কাল’ অর্থাৎ সময়ের জন্মদাত্রী পালনকর্ত্রী এবং প্রলয়কারিণী বলেই দেবীর নাম কালী। তিনি শিব বা শব, অর্থাৎ মৃত্যুর ওপর দাঁড়িয়ে জীবনের প্রতীক। তিনিই চেতনার প্রকাশ।