ঝাড়গ্রাম শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে গভীর জঙ্গল। তার মধ্যেই ঝলমল করে সবুজে ঘেরা কনক দুর্গা মন্দির। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ডুলুং নদী। স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এই জনপদটির আগের নাম ছিল ‘তিহার দ্বীপগড়’, পরে নাম হয় ‘চিল্কিগড়”। এই চিল্কিগড়ের সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ স্বপ্নাদেশ পেয়ে রানির হাতের সোনার কাঁকন দিয়ে দেবী দুর্গার মূর্তি নির্মাণ করান। তিনিই বিগ্রহের নামকরণ করেন 'কনক দুর্গা'। ওড়িশা থেকে আগত ব্রাহ্মণ রামচন্দ্র ষড়ঙ্গীর বংশধরেরা এই রাজপরিবারের কুল পুরোহিত।
ইতিহাস বলছে, রানির হাতের কাঁকন ছাড়াও প্রায় ন'শো সের সোনা লেগেছিল প্রতিমা তৈরিতে। স্থানীয়দের কথায়, সেই মূর্তি নাকি বহু আগেই চুরি হয়ে গিয়েছে। এমনকি তার পরে নির্মিত মূর্তিও চুরি গিয়েছে বেশ কয়েক বার। এখন ওই মন্দিরে যে বিগ্রহ রয়েছে, তা মায়ের নবনির্মিত মূর্তি।
দেবী এখানে অশ্বারোহিণী চতুর্ভূজা। অষ্টধাতুর এই মূর্তিতেই হয় দুর্গাপুজো। প্রাচীন রীতি মেনে পুজো হয়ে আসছে প্রায় সাড়ে চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে। কুলপুরোহিতের কথায়, চিল্কিগড় রাজবাড়ির প্রাচীন প্রথা মেনে ষষ্ঠীর দিন সকালে রাজবাড়ি থেকে শোভাযাত্রা সহকারে রাজবংশের প্রতিনিধি রাজপরিবারের খড়্গ এবং পূর্ণঘট মন্দিরে নিয়ে আসেন। পুজোর ক'দিন মন্দিরে রাখা খড়্গটিকে রাজদণ্ডের প্রতীক হিসেবে মানা হয়। দুর্গাষ্টমীতে হয় পাঁঠাবলি। তা ঘিরে আছে এক আশ্চর্য লোকবিশ্বাস— এই বলির মাংস নাকি ভোগ হিসেবে রাঁধেন স্বয়ং মা দুর্গা! সেই ভোগ 'বিরাম ভোগ' নামে জনপ্রিয় গোটা ঝাড়গ্রামে। অতীতে নবমীতে হত নরবলি। সে প্রথা উঠে গিয়েছে পাল্টানো সময়ের হাত ধরে। এখন হয় মোষ বলি।
নিত্যভোগের সঙ্গে মা কনকদুর্গাকে দেওয়া হয় অন্নভোগ। যে ভোগে থাকে হাঁসের ডিম ও মাছ। এখানে পেঁয়াজ, রসুন, মুসুর ডালকে আমিষ হিসেবে ধরা হয়। বিজয়া দশমীর দিনে মাকে নিবেদন করা হয় পান্তাভাত, শাকভাজা ও মাছপোড়া। এই দিন ঘট বিসর্জনের পরে পালিত হয় 'পাটাবিঁধা' বা 'রাবণবধ' নামের একটি প্রাচীন রেওয়াজ। একটি কলাগাছকে মাটিতে পুঁতে রেখে বেশ দূর থেকে তিরন্দাজেরা তাতে তির ছোড়েন। কলাগাছটিকে আগে যিনি বিঁধতে সক্ষম হন, তিনিই পান পুরস্কার।
এ হেন কনকদুর্গা মন্দিরে এখন লেগেছে অভিনবত্বের ছোঁয়া। চলছে আধুনিক সংস্কার। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দুপাশে রেলিং ঘেরা আঁকাবাঁকা কংক্রিটের পথ ধরে মিনিট দশেক হেঁটে ধরে পৌঁছতে হয় মন্দিরে। পথে বাঁদরের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে হাতে লাঠি রাখেন অনেকেই। এই জঙ্গলে রয়েছে একাধিক বিরল প্রজাতির গাছ। সেই গাছ চুরি আটকাতে প্রশাসন ও বন দফতরের উদ্যোগও চোখে পড়ে। গাছগুলিতে সুন্দর ভাবে বোর্ড দিয়ে তাদের বিজ্ঞানসম্মত নামগুলি উল্লেখ করা রয়েছে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।