দৃশ্যটা হয় বড় অন্যরকম। মনোমুগ্ধকর। অমাবস্যার অন্ধকারে পরপর জ্বলে ওঠে অজস্র আলোর শিখা। মোমবাতির আলো গিয়ে পড়ে ডাকের সাজে সজ্জিত কালীঠাকুরের ওপর। ঝলমল করে ওঠে তাঁর সর্বাঙ্গ। সেই আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে ঠাকুরদালান। পুজোর জন্য সমাগত ভক্তদের মনে ভয় আর শ্রদ্ধার মিশ্র অনুভূতি হয়। ক্রমে মাতৃরূপ আর সংহার রূপ মিলেমিশে যায়। মনে হয় কালীপুজোর রাতের নিকষ অন্ধকার কেটে যাবে দেবীর অভয় হাতের স্পর্শে। বউবাজারে হালদার বাড়ির কালীপুজো ঠিক কবে শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না। বাড়িতে রক্ষিত কিছু কাগজপত্রের মধ্যে ১৭৫০ সালের পুজোর হিসাব নিকাশের কিছু ফর্দ পাওয়া যায়। মনে করা হয় পুজো সেই বছর বা তার কিছু বছর আগে শুরু হয় এই বাড়িতে। তবে হালদার বাড়িতে দুর্গাপুজোর আগে কালীপুজো শুরু হয়েছিল। মধ্য কলকাতার গলিঘুঁজি পেরিয়ে এই বাড়িতে পা দিলে মনে হয় সময় থমকে গিয়েছে যেন।
বউবাজারের রমানাথ কবিরাজ লেনের এই বাড়ির স্থাপত্য আর দশটা বনেদিবাড়ি থেকে একটু আলাদা। জাফরির কাজ, একখিলানের ঠাকুরদালান সময়ের সঙ্গে খানিক আধুনিকতার ছাপ মেখেছে গায়ে। উঠোনের দেওয়াল জুড়ে দশ মহাবিদ্যার বহু পুরনো অয়েলপেন্টিং। সব মিলিয়ে কোথাও যেন একটু অন্যরকম বাড়িটা। হুগলি এবং বর্ধমানের মধ্যবর্তী বাদলা গ্রামের জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণ হালদার প্রচুর জমিজমার মালিক ছিলেন। কলকাতায় এসে তাঁর পরিবারের লোকজন শুরু করেন ব্যবসা। এই পরিবারের রাখালদাস হালদার জন ইয়েটস অ্যান্ড কোম্পানির কলকাতার এজেন্ট ছিলেন। ইস্পাত থেকে শুরু করে জাহাজের ব্যবসা সবেতেই সোনা ফলাতেন তিনি। তাঁর অর্থ এবং খ্যাতি এতটাই ছিল যে তিনি সেইসময় ক্যালকাটা ক্লাব এবং বেঙ্গল ক্লাবের সদস্য ছিলেন। কলকাতার প্রথম পঞ্চাশটি ল্যান্ডলাইনের একটি ছিল তাঁর। শুধু তাই নয়, শোনা যায় পরিবারের এক সদস্যার অস্ত্রোপচার করানোর জন্য বাড়ির একটি ঘরকে অপারেশন থিয়েটারে বদলে দিয়েছিলেন তিনি। পরে বেশ কয়েকবার বাড়ির মেয়েদের অপারেশন সেখানেই হয়েছে।
এ হেন বিত্তশালী বাড়িতে পুজোও যে ধূমধাম করে হবে তা তো বলাই বাহুল্য। রাখালদাস বাবুর সময়ে বাড়ির কালীপুজো আলাদা মাত্রা পায়। হালদার বাড়িতে দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন কালীঠাকুরের কাঠামো পুজো হয়। লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে ঠাকুর তৈরির কাজ শুরু হয়। মাটির কাজ সম্পূর্ণ হলে কৃষ্ণনগর থেকে লোক আসে দেবীকে ডাকের সাজ পরাতে। এরপর ঠাকুর দালানে একাদশী তিথিতে পাঁচকলাই আর পঞ্চশস্য দিয়ে গঙ্গামাটির বেদি তৈরি করা হয়। তার ওপরে পাতা হয় চৌকি। মূর্তিকে পুজোর দু’তিন দিন আগে চৌকিতে তোলা হয়। অমাবস্যা পরার পর তিথি দেখে ঘট পাতা হয়। কালী পুজো শুরুর আগে প্রথমে অলক্ষ্মী বিদায় করা হয়। গোবর দিয়ে অলক্ষ্মীর এবং চালের পিটুলি দিয়ে দেবী লক্ষ্মী নারায়ণ আর কুবের এর মূর্তি তৈরি করা হয়। অলক্ষ্মী পুজোর পর কুলো বাজিয়ে প্যাকাঠি জ্বালিয়ে তিন মাথার মোড়ে গিয়ে অলক্ষ্মী বিদায়ের পর বাড়ি এসে দীপান্বিতা লক্ষ্মী পুজো করা হয়। সেই সময় ঠাকুর ঘর থেকে মঙ্গলচণ্ডীর ঘট, লক্ষ্মী নারায়ণ এবং মহাদেবে মূর্তি নামানো হয়। তারপর শুরু হয় কালীপুজো। পুজো শুরু হলে বাড়ির সমস্ত বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। পুরো বাড়ি আর ঠাকুরদালান জুড়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় মোমবাতি আর প্রদীপ। আগে বাড়িতে পাঁঠাবলি হত। ১৯২০ নাগাদ হালদার বাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে আসেন শেফিল্ড স্টিল এর মালিক জন ইয়েটস। তিনি পুজো দেখে এতটাই মুগ্ধ হন যে কলকাতা থেকে দেশে ফেরার সময় বলির খাঁড়ার নকশা এঁকে নিয়ে যান। কিছুদিনের মধ্যেই দেশে থেকে রূপোর মত ঝকঝকে সুদৃশ্য একটি খড়্গ জাহাজে পাঠান তিনি। তাতে বাংলা সাল তারিখ সহ লেখা ছিল ‘শ্রী শ্রী দুর্গা’। কিন্ত সেই খাঁড়া এত ভারী ছিল যে তা দিয়ে বলি দিতে গিয়ে হাঁফিয়ে যান লোকজন। সেই কথা জানতে পেরে ফের একটি খাঁড়া পাঠান ইয়েটস সাহেব। এই বাড়িতে যেহেতু কালীপুজোর মাহাত্ম্য ছিল বেশি, রাখালদাস হালদার ঠিক করেন, এই খাঁড়া দিয়ে কালীপুজোর সময় পাঁঠাবলি দেওয়া হবে। কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে সেই প্রথাই চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৪৬ সালে বাড়িতে পাঁঠাবলি বন্ধ করে দেন রাখালবাবু। ছেচল্লিশ এর ভয়ানক দাঙ্গা, রক্তারক্তি তাঁকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। নিজের বাড়িতে আর রক্তপাত চাননি তিনি। সেই থেকে ওই খাঁড়া দিয়েই পুজোর সময় আখ, চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। বলির সময় মশাল জ্বালানো হয়। মোমবাতির স্নিগ্ধ আলোর সঙ্গে মশালের তীব্র আলো মিলেমিশে আলো ছায়ার বুনটে মোহময় হয়ে ওঠে ওঠে ঠাকুরদালান।
আরও পড়ুন: জনাইয়ের বাকসা মিত্রবাড়ির পুজোর বোধন হয় ১৫ দিন আগে
জন ইয়েটসের পাঠানো রূপোর মত উজ্জ্বল খাঁড়া দিয়েই পুজোর সময় আখ, চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়।
আগে ভোগে দেবীকে বাটা চিনি চূড়োর মত করে দেওয়া হত। নিয়ম ছিল প্রতিমার জিভ পর্যন্ত পৌঁছবে চিনির চূড়ো। এখন পরিমাণ কমেছে অনেকটাই। চিনির নৈবেদ্য ছাড়াও দেবীকে দেওয়া হয় চালের নৈবেদ্য নানারকম ফল আর মিষ্টি দিয়ে সাজিয়ে। মনোহরা, রসকড়া, নাড়ু , ক্ষীর লুচি পায়েস ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। বিসর্জনের সময় সিঁদুর খেলার পর পান সুপারি আর চাল দিয়ে কনকাঞ্জলি দেওয়া হয়। দেবীর বিসর্জন মানে বাপের বাড়ি ছেড়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়া। তাই বিসর্জনের দিন বিষণ্ণ হালদার বাড়িতে রান্না হয় না।
আরও পড়ুন: পুজোয়ে প্রামাণিক বাড়ির ঠাকুরদালানের সামনে বসত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর
আগে বিসর্জনের সময় প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া হত কাঁধে করে। সঙ্গে যেত ঢোল আর সানাই বাদকের দল। ঠাকুর নিয়ে জোড়া নৌকা যেত গঙ্গায়। একটি নৌকা থেকে বিসর্জন হত, অন্য নৌকায় জ্বলে উঠত হাজার রংমশাল। রাতের গঙ্গা আলো হয়ে যেত রংমশালের রঙিন বাহারে। এখন আর সেসব কিছু হয় না। বিসর্জনের পর অন্ধকার বাড়ি নিশ্চুপ পড়ে থাকে, আগামী বছর আরও একবার দীপালোকিত হয়ে ওঠার অপেক্ষায়।
দেবাশীষ কুমার