মাত্র ছয় বছর বয়স ছেলেটার। পথশ্রমে ক্লান্ত একেবারে। কম রাস্তা তো নয়। মেদিনীপুর থেকে হাওড়া হাঁটছে সে আর তার মা। সদ্য বিধবা মায়ের হাত ধরে এতটা পথচলা। এর আগে এত পরিশ্রম কখনও করেননি তার মা। বড় ঘরের মেয়ে তিনি, বড় ঘরের বউ। পরিশ্রমের অভ্যাসই ছিল না- মেদিনীপুরের কাকদাঁড়ে ঘোষেদের বিরাট জমিদারি। সে জমিদারেরা আবার ছিলেন সিরাজের বন্ধু। সিরাজ তখনও নবাব হননি, বাংলা বর্গী আক্রমণে বিধ্বস্ত। সে বন্ধুত্ব আর বিশ্বস্ততা এতটাই গভীর যে, নবাবের সৈন্যরা যাতে অবাধে যাতায়াত করতে পারে, তার জন্য বর্গীদের সঙ্গে এক সংঘর্ষের সময়ে ধানের শিষ আর তুষ দিয়ে নিজেদের এলাকার সব খাল বুজিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। এতে যে ক্ষতি হয়েছিল, তার পরোয়া করেননি জমিদাররা। আর এর ফলে এতটাই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন বাংলার নবাব যে, বিপুল পুরস্কারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি এই পরিবারকে দেন পলমল উপাধি। মেদিনীপুরের সেই বিরাট বাড়ি, নাম-খ্যাতি-অর্থ বা উপাধি, সবই রাতারাতি ছেড়ে দিয়ে আসতে হয়েছে তাদের।
বালকটির বাবা মারা যাওয়ার পরে এমন ভয়ংকর রূপ ধরল স্বার্থ আর গৃহবিবাদ যে, সেখানে ছোট ছেলেটিকে নিয়ে থাকার আর সাহস পেলেন না তার মা। তিনি নিজেও ভীষণ অভিমানিনী ছিলেন। পিতৃগৃহেও ফিরে যেতে চাইলেন না আর। অগত্যা পথই ভরসা। এ দিকে, রাস্তায় রাতে দস্যুর ভয়। সারা দিন হেঁটে রাতে মা-ছেলে আশ্রয় নেন কোনও গৃহস্থবাড়িতে। পরের দিন আলো ফুটতে না ফুটতে আবার হাঁটা।
বেশ কিছু দিন অক্লান্ত হাঁটার পরে দু’জনে এসে পৌঁছলেন হাওড়ার নুনগোলা ঘাটে। এখানেই একটা ছোট্ট কুঁড়েতে আশ্রয় নিলেন তারা। ছেলেটি ওইখানে শ্রমিকের কাজ নিল। সারা দিন নিদারুণ পরিশ্রম। রাতের বেলা হা-ক্লান্ত বাচ্চাটা দিনমজুরীর যৎসামান্য টাকা এসে তুলে দিত মায়ের হাতে। তার মালিক মানুষ চিনতেন বিলক্ষণ। তিনি দেখলেন, একফোঁটা বাচ্চাটা যেমনি পরিশ্রমী, তেমনই জেদি। অতীতের কথা ভুলেও মুখে আনত না সে আর তার মা। কিন্তু ছেলেটির সর্বাঙ্গে গয়নার কালি নজরে পড়েছিল মালিকের। ছেলেটিকে আস্তে আস্তে দায়িত্ব দিতে লাগলেন তিনি। তখন কৈশোরে পৌঁছেছে সে দিনের বাচ্চাটি। নুনের গোলাটি এক দিন মালিকের কাছ থেকে কিনে নিল সে।
ঘোষবাড়িতে দেবীর কাঠামো পুজো হয় উল্টো রথের দিন।
এর পরের ইতিহাস প্রায় উল্কা গতিতে উত্থানের। তত দিনে মাধবচন্দ্র ঘোষকে এক ডাকে চেনে হাওড়ার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। এর পরে তিনি শুরু করলেন বাঁশ, লোহালক্কড় আর ওষুধের ব্যবসা। সেই সঙ্গে কাজ শুরু করলেন বন্দরে। তখন বন্দরগুলিতে নিয়মিত এসে ভেড়ে ব্রিটিশ জাহাজ। জলপথে ব্যবসা চলে অজস্র। বাঙালিদের প্রচুর কাজ সেখানে। কারও রয়েছে জাহাজ মেরামতির কারখানা। কারও আবার নিজস্ব জাহাজ চলে। মাধববাবু কিছু দিনের মধ্যেই বুঝে গেলেন এই ব্যবসার হালচাল। তিনি গার্ডেনরিচে বিডি বিল্ডার্স নামে জাহাজ মেরামতির কারখানা তৈরি করলেন। ভাগীরথী এবং গঙ্গাসাগর নামে দুটো জাহাজও কিনে নিলেন। এত দিন কাটিয়েছেন সেই ভাঙা কুটিরে। অতীত মনে রাখতেই সম্ভবত। তখন তাঁর বয়স ২০ বছরও পেরোয়নি, হাওড়ায় বাড়ি তৈরি করে ফেললেন মাধবচন্দ্র ঘোষ। সেই বাড়ির ঠাকুরদালানে প্রতিষ্ঠা করলেন রাধা-মাধব মূর্তি। কিছু দিন পরেই যে বাড়ি ছেড়ে এসেছেন, তার আদলে এ বাড়িতে শুরু করে দিলেন দুর্গা পুজো। কিন্তু সেই সময়ের রীতি মেনে দেবীর মুখ তৈরি করলেন না। দেবীর মুখ ঈশ্বরীর মতো না হয়ে হল মানবীর মতো। তিনি তাঁকে কল্পনা করলেন মাতৃরূপে। আয়তাকার চোখ, কোঁকড়া চুল আর লাবণ্যময়ী দেবীমূর্তির দিকে তাকালে আর চোখ ফেরানো যেত না। এত অল্প বয়সে ছেলেটি করে ফেলেছে এত কিছু- হাওড়ার ওই এলাকার মানুষ কুঁড়েঘর থেকে রাজপ্রাসাদে উত্থানের ইতিহাস সবটাই জানতেন। তাঁরা নিজেদের পুজো মনে করেই দেবীকে বরণ করলেন সাদরে।
আরও পড়ুন: সময় যেন থমকে দাঁড়ায় মারহার ঘোষবাড়ির পুজোয়
ঘোষবাড়িতে দেবীর কাঠামো পুজো হয় উল্টো রথের দিন। কাঠামোতে মাটি দেওয়া হয় জন্মাষ্টমীর দিন। প্রতিমা তৈরি হয় বাড়িতেই। প্রতিমার অঙ্গে থাকে শোলার সাজ। চালচিত্রে বিষ্ণুপুরাণ আর চণ্ডীপুরাণ চিত্রিত থাকে। ষষ্ঠীর দিন বোধন। সেই দিনই প্রতিমাকে পরানো হয় সোনার অলঙ্কার। হাতে দেওয়া হয় রুপোর অস্ত্র। সপ্তমীর দিন কলাবৌ স্নানের পরে তাঁর চক্ষুদান হয়।
ঠাকুরদালানে যেখানে রাধা-মাধব থাকেন, সেখানেই হয় দুর্গাপুজো। সপ্তমীতে চক্ষুদানের পর একটি বলি হয়, তার পরে হয় সপ্তমীর বলি। অষ্টমীর দিন দু’টি এবং নবমীর দিন তিনটি বলি হয়। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় বলে চালকুমড়ো, আখ, শসা- এই সবই বলি দেওয়া হয়। পশুবলির রীতি নেই।
ঠাকুরদালানে যেখানে রাধা-মাধব থাকেন, সেখানেই হয় দুর্গাপুজো।
বাড়িতেই নারায়ণ এবং শিবের মন্দির। তাঁদের পুজোর সময়ে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। ভোগে দেবীকে মিষ্টি, চিনি, চাল, ফলমূল দেওয়া হয়। রাতে শীতল ভোগে দেওয়া হয় গাওয়া ঘিয়ের লুচি আর মিষ্টি। নবমীর দিন কুমারী পুজো হয়। তার পরেই এ বাড়ির সবথেকে আলাদা এবং অন্য ধরনের রীতিটি পালিত হয়। ঘোষবাড়িতে পরিবারেরই কোনও বধূকে প্রতি বছর দেবীরূপে পুজো করা হয়। যাঁকে পুজো করা হবে, তাঁকে এই দিন প্রতিমার সামনে ধুনো পোড়ানোর সামগ্রী হাতে এবং মাথায় নিয়ে বসতে হয়। পুরোহিত তাঁকে পুজো করেন। এর পরে তাঁকে প্রণাম করেন ছোট-বড় নির্বিশেষে বাড়ির সব সদস্য। দশমীর দিন নুনগোলা ঘাটে দেবীর বিসর্জন হয়।
আরও পড়ুন: বিজয়িনীর হাসি আর আয়ত চোখের স্নিগ্ধতায় অনন্যা মাতৃমূর্তি
ঘোষবাড়িতে পুজোর প্রতিদিন নানা অনুষ্ঠান হয়। বাউলগান, কবিগান তো হয়ই, সেই সঙ্গে রাজ্যের নানা লুপ্তপ্রায় শিল্প সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা হয় প্রতি বার। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এ বাড়িতে পুজোর সময়ে এসে স্তোত্রপাঠ করেছেন। এসেছেন আমজাদ আলি খান, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরাও। এ বার করোনা-আবহে পুজোয় অবশ্য আগের মতো অনুষ্ঠান করছে না হাওড়া ঘোষবাড়ি। তবে, সামাজিক দূরত্ব মেনে মাস্ক পরে পুজো দেখতে আসতে পারবেন দর্শনার্থীরা।
ছবি সৌজন্যে: অমিতাভ গুপ্ত