নবমীর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল…। সন্ধ্যা আরতির ধুনোর গন্ধটা ক্রমেই মৃদু হয়ে আসছে। সাত খিলানের ঠাকুরদালানে জ্বলতে থাকা ঝাড়বাতিতে মেয়াদ ফুরনো মোমবাতির শিখা কাঁপতে থাকে অবিরত। চারপাশের এত রোশনাই দেখতে দেখতে ফিকে হয়ে আসে। মনের মাঝে তখন বেজে ওঠে একটাই সুর…‘নবমী নিশি গো তুমি আর যেন পোহায়ো না।’ নবমীর রাত যত বাড়ে এক অদৃশ্য বিষন্নতাও যেন গ্রাস করে বনেদি বাড়ির ঠাকুরদালান থেকে বাড়ির আনাচ কানাচ।
‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ…ঠাকুর যাবে বিসর্জন…’ দশমীর সকাল থেকেই আবারও হরেক ব্যস্ততা। সে দিন ঢাকের বোলেও যেন অন্য সুর। সকাল সকাল বাড়ির সকলেই হাজির ঠাকুরদালানে। পুজোর শেষ আরতি, দধিকর্মা নিবেদন শেষে ঠাকুরমশাইয়ের ঋজু কণ্ঠে ‘গচ্ছ গচ্ছ পরম স্থানং স্বস্থানং পরমেশ্বরী…’ দেবীকে বিদায় জানানোর মন্ত্র। সুতো কাটার পরে অবশেষে শান্তির জল। হলুদগোলা জলে দর্পণ প্রতিবিম্বে দেবীর মুখ ও পা দেখে মনের বাসনা জানানোর প্রথা চলে আসছে সেই কোন কাল থেকে। কোথাও বা কুলাচার মেনে হয় অপরাজিতা পুজো। বেশ কিছু পরিবারে রয়েছে কনকাঞ্জলি প্রথাও। দুপুর হতেই পঞ্জিকার শুভক্ষণ দেখে বেদী থেকে প্রতিমা নামানো, তার পরেই শুরু হয় বরণ পর্ব। প্রতিমাকে প্রদক্ষিণ, অধিবাসের ডালা থেকে বিভিন্ন সামগ্রী দেবীর পায়ে ছোঁয়ানো। সব শেষে দেবীর পায়ে ও সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে সধবাদের সিঁদুর খেলা। যুগ যুগ ধরে এটাই দশমীর পরিচিত ছবি।
আরও পড়ুন: মা লক্ষ্মী ঘরের মেয়ে, তাই বিদায় দেয় না বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার
পুজোর ক’দিন নিরামিষ খাওয়াদাওয়ার পরে দশমীর দুপুরে আমিষ খাওয়ার রীতি দেখা যায় বহু পরিবারে। বহু পরিবারের গৃহকর্ত্রী মাছ-ভাত খেয়ে বিকেলে দেবীকে বরণ করেন। তবে বিসর্জন শেষে সব পুজো বাড়িতেই একই চেহারা। ঠাকুরদালানে প্রদীপের ম্লান আলোয় শোভা পায় জল ভরা দেবীঘট, দেবীর চালচিত্র, কোথাও বা ভিজে কাঠামো। কয়েক দিনের উৎসব শেষে দশমীর সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় এক বছরের নীরব প্রতীক্ষা।
শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গা প্রতিমা
একাদশীর সকালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে গেলে দেখা যায় এক বিষন্ন ছবি। অথচ কয়েক ঘণ্টা আগেও তা ছিল অন্য রকম। পুজো উপলক্ষে মিষ্টি তৈরির ভিয়েন বসেছিল। এ বার পুজো শেষে বাসনপত্র মেজে তুলে রাখার পালা। তার পাশাপাশিই চলে পুজোর বিভিন্ন কাজে যুক্ত মানুষদের পাওনা-গণ্ডা মেটানোর পর্ব। শুধু তো একটা মাটির প্রতিমা ঘিরে উৎসবে মেতে ওঠা নয়। এ যেন বছর পেরিয়ে বাড়ির মেয়ের ঘরে ফেরা। তাই তো এ পুজোয় মিশে আছে এত আনন্দ, এত আন্তরিকতা। এক পুজোবাড়ির কর্তা স্মৃতিমেদুর হয়ে বলছিলেন, বিজয়া এলেই মেয়ের বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়।
কলুটোলায় বদনচন্দ্র রায়ের বাড়িতেও পুজো শেষে আলো ঝলমলে পরিবেশ ঝুপ করে ডুব দেয় আঁধারে।একে একে ঢেকে ফেলা হয় সাবেক বেলোয়ারী ঝাড়বাতিগুলো। উঠোনের ছোট থামের উপর অলঙ্করণযুক্ত কাচের গোলাগুলিকে সযত্নে খুলে রাখা হয়।
কলুটোলার বদনচন্দ্র রায়ের বাড়ি
দশমীর সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জনের পরে হাটখোলার দত্তবাড়িতেও উধাও হয়ে যায় উৎসবের উন্মাদনা। পরিবারের এক প্রবীণ সদস্যের কথায়: পুজো উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত-অপরিচিত এত মানুষের আনাগোনা হঠাৎ থেমে যায়। কয়েক দিনের যোগাযোগ দেখা-সাক্ষাৎ পেরিয়ে আচমকা যেন এক বছরের অলিখিত বিচ্ছেদের পালা। পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা হয় পুজোর কটা দিনে। তবে সবচেয়ে মন খারাপ হয় ছোটদের। প্রতিমা বিসর্জনের সময় গঙ্গার ঘাটে তাদের কান্না যেন মনটাকে আরও ভারাক্রান্ত করে তোলে।
ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোডের মিত্র বাড়িতে বিসর্জনের আগে গৃহকর্ত্রী তাঁর মাথার চুল প্রতিটি প্রতিমার পায়ে বেঁধে দেন। দেবী যাতে আগামী বছর আবার এই গৃহে ফিরে আসেন- তারই বার্তা হিসেবে।
মিত্র বাড়িতে বিসর্জনের আগে গৃহকর্ত্রী তাঁর মাথার চুল প্রতিটি প্রতিমার পায়ে বেঁধে দেন
পুজো উপলক্ষে মফসসল ও জেলা থেকে বংশপরম্পরায় বহু মানুষ রোজগারের আশায় বনেদি বাড়িগুলিতে আসেন। পুজোর ক'দিন তাঁরা নানা ধরনের কাজও করেন। দশমীর বিকেলে প্রতিমা নিরঞ্জনের পরে তাঁদের ঘরে ফেরার পালা। এ বছর অবশ্য করোনার জন্য এবং ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় আসতে পারেননি অনেকেই।
আরও পড়ুন: ঈর্ষাতেই নিজগৃহে দেবীর বোধনের ইচ্ছা হল রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
তবে কিছুটা অন্য রকম ছবি দেখা যায় মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের শীলবাড়িতে। এ বাড়িতে পুজোর ক'দিন সম্পূর্ণ নিরামিষ আহার করেন বাড়ির সদস্যরা। দশমীর পুজোর শেষে সুতো কাটার পরে পরিবারের সদস্যরা বাজারে গিয়ে মাছ, পালংশাক কিনে আবার দৈনন্দিন রান্নাবান্না শুরু করেন। একাদশীর দিনে এই বাড়ির পরিবারের সদস্যরা মিলিত হন এক প্রীতিভোজে। বাজার করা থেকে রান্নাবান্না সবই করেন ছেলেরা। তাই এই পরিবারে পুজোর সমাপ্তি বিষন্নতায় নয়, উৎসব শেষ হয় কব্জি ডুবিয়ে খাওয়াদাওয়ায়!