Durga Puja 2019

পুজোয় ভবানীপুর মল্লিকবাড়িতে শুধু দশমীতেই আমিষ, থাকে মেটে চচ্চড়ি

বাড়ির পুজোয় থাকবেনই রঞ্জিত-কোয়েল-প্রমিতা।

Advertisement

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৯ ১৪:৪৮
Share:

পুরনো বাড়ির লাল মেঝে সবুজ জাফরিতে স্মৃতিভেজা নস্টালজিয়া। রেলিং-এর ধার বরাবর উঠে যাওয়া মাধবীলতা থেকে টুপটাপ ফুল ঝরে পড়ে উঠোনে। গুপ্তিপাড়া থেকে মল্লিকরা ভবানীপুরে এসে যখন বাড়িটি তৈরি করেছিলেন তখন আশেপাশে খুব বেশি বাড়ি ছিল না। ধুমধাম করে সেইসময় অন্নপূর্ণা পুজো হত বাড়িতে। আশেপাশের লোক আসত ভিড় করে। ঠাকুর দেখে প্রসাদ নিয়ে যেত। অন্নপূর্ণা পুজো শুরু করার কিছুদিন পরেই দুর্গাপুজো শুরু করেন মল্লিকরা। যতদূর জানা যায় এর আগে গুপ্তিপাড়ার বাড়িতেও দুর্গাপুজো হত। সেই পুজোর আচার-অনুষ্ঠান ছাপ ফেলেছিল নতুন করে শুরু করা এই পুজোতেও। ১৯২৫ এ রাধাগোবিন্দ মল্লিকের ছেলে সুরেন্দ্রমাধব মল্লিক এই পুজো শুরু করেন। সুরেন্দ্রমাধব মল্লিকের ভাই ইন্দুমাধব মল্লিক ছিলেন খ্যাতিমান মানুষ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের অন্যতমইন্দুমাধব ছিলেন ইকমিক কুকারের আবিষ্কর্তা। অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের ও কোয়েল মল্লিক এই বাড়ির সন্তান। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী প্রমিতা মল্লিক এই পরিবারেরই বধূ।

Advertisement

মল্লিকবাড়িতে জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজো হয়। প্রতিপদ থেকে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। পঞ্চমীর দিন চণ্ডীরঘরের সামনে বোধন হয়। সাবেকি ছাঁদের একচালা মহিষাসুরমর্দিনী রূপে থাকেন দেবী। প্রতিমার চালায় থাকেন মহাদেব। দুর্গার অঙ্গে থাকে ডাকের সাজ। নাকের নথ, গলার হার থেকে সোনার টিপ, দেবীর সব অলংকার পরান মেয়েরা। এরপর বাড়ির পুরুষরা দেবীর হাতে অস্ত্র তুলে দেন। সাজ সম্পূর্ণ হয় প্রতিমার। ঠাকুরদালানের আলো-ছায়ায় ঝলমল করে ওঠে স্নিগ্ধ মাতৃমূর্তি। এই বাড়িতে পুজো হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকামতে।

বাড়ির কুলদেবতা শ্রীধর। তাঁকে পুজো শুরুর সময় দেবীর পাশে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। দশমীর দিন তুলে দেওয়া হয় উপরে। মল্লিকবাড়িতে কলাবউকে স্নানের জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় না। সপ্তমীর দিন কলাবউ স্নান হয় বাড়ির উঠোনেই। বৈষ্ণবমতে পুজো হয় বলে এই বাড়িতে বলি হয় না। অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো হয়। এরপর সন্ধিপুজো হয়। ১০৮টি প্রদীপ সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয় উঠোন জুড়ে। ঠাকুরকে অন্নভোগ বা ভাজা মিষ্টি দেওয়া হয় না। লুচি , আলু ফুলকপির বা আলুপটলের ডালনা নানারকম ভাজা দেওয়াহয়। এছাড়াও থাকে মিষ্টি, নাড়ু, ফল। অষ্টমীর দিন চালের চূড়া করে নানারকম ফল,মিষ্টি, মেওয়া দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া হয়। এদিন রাতে ঠাকুরকে দেওয়া হয় ক্ষীর।

Advertisement

নবমীর দিন হোম হয়। আগে এই দিন পুজো শেষে বাড়িতে নানারকম অনুষ্ঠান হত। নাচ, গান নাটক জমজমাট মজলিশ বসত বাড়ির উঠোনে। বাড়ির বড় থেকে একদম বাচ্চারা সবাই অংশগ্রহণ করত তাতে।‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ থেকে ‘সিরাজউদদৌল্লা’-র মতো ঐতিহাসিক নাটক অথবা ‘ভাড়াটে চাই’-এর মত হাসির নাটকে জমে উঠত সভা। সে সব এখন আর হয় না।স্মৃতিমেদুর গলায় পুরনো দিনের কথা বলছিলেন অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক। বললেন , ‘ আমাদের পুজো শুরু হয়ে যেত পুজোর একমাস আগেই। বাড়িতে ঠাকুর তৈরি হওয়া, রং করা সবকিছুই খুব আকর্ষণীয় ছিল আমাদের কাছে। স্কুল থেকে ফিরেই বসে যেতাম ঠাকুর তৈরি করা দেখতে। পুজো আসছে ভাবলেই আনন্দে মন প্রাণ ভরে যেত। শৈশবের সেই সব দিন আলাদা ছিল একদম।’

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু পালটিয়েছে। কিন্তু পুজোর আনন্দ ম্লান হয়নি। যখন অভিনেতা হিসাবে নামডাক, সেই সময়েও পুজোর দিনগুলিতে বাড়ির বাইরে পা রাখেননি কখনও। এই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়স্বজনরা বাড়িতে আসেন। সারা বছরে এই একবার সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। পারিবারিক মিলনক্ষেত্র ছেড়ে বাইরে যেতে মন চায় না কারওরই।

মুনমুন সেনের মত যে সব অভিনেতা অভিনেত্রীর সঙ্গেমল্লিকপরিবারের পারিবারিক সম্পর্ক, তাঁরা সপরিবারে এই সাবেক পুজো দেখতেএসেছেন।অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিকও পুজোর দিনগুলিতে বাড়িতেই থাকতে পছন্দ করেন। কুমারী পুজোর দিন কুমারীকে সাজান যত্ন করে। কখনও ভোগ পরিবেশন, কখনও বা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী প্রমিতা মল্লিক বললেন, ‘অশুভ শক্তিকে দমন করে শুভ শক্তির যে জয়গান দুর্গাপুজোয় ধ্বনিত হয় তার সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। বছরের এই সময় মানুষ তাঁর সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়। দুর্গাপুজোরসেরা প্রাপ্তি সেটা।‘ বাইরে অনুষ্ঠান না থাকলে বাড়ির পুজোয় উপস্থিত থাকেন তিনিও।

পুজোর প্রতিদিন দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেন বাড়ির সদস্যরা। দশমীর দিন বাড়ির যিনি সবথেকে বড়, তিনি বরণ করেন সবার প্রথমে। তারপর একে একে অন্যরা দেবী-বরণ করেন। বিসর্জনের দিন বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঢাকের তালে শোভাযাত্রার নাচে পা মেলান রঞ্জিত মল্লিক। বৈষ্ণব বাড়ি বলে পুজোর কয়েকটা দিন আমিষ খাওয়া হয় না। বিসর্জনের পর দশমীর রাতে আমিষ খাওয়ার নিয়ম। আরও নানা খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে মল্লিক বাড়ির সিগনেচার ডিশ, মেটে চচ্চড়ি। পুজো শুরুর দিনটি থেকে এই একটি রান্না এখনও একইভাবে হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন : এ বছর প্রতিমার সাজে পুরনো ঘরানা ফিরিয়ে আনছে শোভাবাজার রাজবাড়ি​

বিসর্জনের রাতে শুন্যঠাকুরদালানে প্রদীপ জ্বলে ওঠে। মন ভারাক্রান্ত হয় সকলের। ভরা বাড়ি খাঁ খাঁ করবে আবার। আত্মীয়স্বজন চলে যাবেনতাঁদের কর্মক্ষেত্রে। তার আগে, দশমীর নিঝুম রাতে মল্লিকবাড়ির ঠাকুরদালানে বসে গানের আসর। কিছু গান প্রতিবছরইগাওয়া হয়। ‘ধন্য ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক.....’সেরকমই একটি গান। বাড়ির সবাই গলা মেলান সেই গানে।সুরে সুরে কেটে যায় বিদায়ের বিষাদ।

ছবি সৌজন্য: মল্লিক পরিবার

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement