বাঙালির দুর্গাপুজো চিরকালই এক ছুঁয়ে ফেলার উৎসব। আনন্দ দিয়ে আকাশকে ছুঁয়ে ফেলা, রাত্রি দিয়ে আলোকে ছুঁয়ে ফেলা, শিউলি দিয়ে প্রতিমাকে ছুঁয়ে ফেলা, গান দিয়ে হৃদয়কে ছুঁয়ে ফেলা—এমন আরও কত কী! সব থেকে বড় কথা, এই দুর্গাপুজো তো আত্মীয়-বন্ধুদের ছুঁয়ে ফেলারই জন্যে। পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে বহু দিন পরে ছেলেবেলার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে, তাকে জড়িয়ে না ধরে কি থাকা যায়? একসঙ্গে বাড়ির সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে দেখতে যখন কোনও আত্মীয়র বাড়ির কাছাকাছি, তখন তাঁর বাড়িতে হঠাৎ না-বলে-কয়ে দেখা করার জন্যে ঢুকে পড়লে, তিনিই কি আমাদের বুকে না-জড়িয়ে থাকতে পারেন? কিন্ত এই সবগুলো ‘ছুঁয়ে ফেলা’র গায়েই এ বার একটা বিরাট বড় প্রশ্নচিহ্ন বসে গিয়েছে। যার কারণটা আমাদের কারওরই অজানা নয়। ছোঁয়া দূরে থাক, এক জনের নিঃশ্বাস অন্য জনের গায়ে এসে পৌঁছতে পারে যে দূরত্ব পার করে, এ বার নাকি তার থেকেও বেশি তফাতে থাকতে হবে সব্বাইকে।
নিজের প্রেমিকার গা-ঘেঁষে প্রেমিক ছেলেটি কি আদৌ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে এ বারের পুজোয়? তাদের গোপন কথাবার্তা, মাস্কের তিনটি লেয়ার পার করে, ফিসফিসানির মধ্যে কতটা যে আটকে থাকবে—তা বলা সত্যিই কঠিন। এই পুজোয় তারা কি এক বার অন্তত দু’জনে দু’জনের হাত ধরতে পারবে? নাকি সিন্থেটিক গ্লাভসে পিছলে যাবে ভালবাসার পাঁচ জোড়া আঙুল!
আরও পড়ুন: গরম জামা রোদে দেওয়া মানেই পুজো আসছে
ফি বছর পুজোর ক’দিন পাড়ার মণ্ডপে কয়েক জন কিশোরকে দেখতে পাওয়া যায়, যারা সন্ধের দিকে প্যান্ডেলের ভিতরে পাতা প্লাস্টিকের চেয়ারে গোল হয়ে বসে হাসিহাসি মুখে আড্ডা দেয়। কিন্তু সকালের দিকটায় খুবই ব্যস্ত থাকে। সকালে এদের কাজ হল—অঞ্জলির সময়ে মণ্ডপের প্ল্যাটফর্মের উপরে দাঁড়িয়ে, পুরোহিতমশায়ের কাছ থেকে ছোট ঝুড়িতে করে কুচো ফুল, বেলপাতা নিয়ে সব্বার হাতে, বিশেষত নতুন শাড়ি পরে অঞ্জলি দিতে আসা কিশোরীদের হাতে যত্ন করে গুঁজে দেওয়া।
আর সেই এক পলকের একটু আঙুল ছোঁয়ার মধ্যে দিয়ে গোটা পুজোর এনার্জি কালেক্ট করে নেওয়া।
বিজয়ার দিনটায় যে কী হবে, তা ভেবে তো কূল পাচ্ছি না!
এ বার কি ওই চমৎকার দৃশ্যটা, আগের বছরগুলোর মতোই দেখতে পাওয়া যাবে? নাকি অঞ্জলি দেওয়া ব্যাপারটাই এ বার আর থাকবে না! যে যার ড্রয়িংরুমে বসে, নিজেদের মোবাইলের স্ক্রিনে দেবীকে দেখে সবাই অঞ্জলি দিয়ে নেবে আর একটা নির্দিষ্ট বোতামে হাত ছোঁয়ালেই কিছুটা থ্রি-ডি ফুল লাফিয়ে পড়বে দেবীর পায়ে। বন্ধুরা মিলে পুজো লাগোয়া খোলা মাঠে গোল হয়ে বসে যে আড্ডা—তারই বা এই পুজোয় ভবিষ্যৎ কী?
আরও পড়ুন: মলমাসের দৌলতে কি এবার পুজোর ফুর্তি বাড়ছে বাঙালির
পাড়ার পুজোয় প্রতিদিন সবাই মিলে একসঙ্গে ভোগ খাওয়া, এ বছর সেটারই বা কী হবে? আমরা কি মিনিট পনেরোর জন্যে গ্লাভস আর মাস্ক খুলে, একই টেবিলে পাশাপাশি বসে খিচুড়ি, আলুর দম আর গরম-গরম বেগুনি খেতে খেতে গপ্পো করতে পারব? নাকি বাংলা মিডিয়াম স্কুলের ক্লাসঘরের মতো লম্বা বেঞ্চি পেতে, দু’প্রান্তে দু’জন করে বসে, নিঃশব্দে ভোগ খেয়ে উঠে যাব। একমাত্র কচমচ করে বেগুনি চিবোনো আর কুড়মুড় করে পাঁপড় ভাঙার শব্দ ছাড়া কোত্থাও কোনও শব্দই সেখানে পাওয়া যাবে না!
নতুন জামাই পুজোর সকালে শ্বশুরবাড়িতে এলে তাকে গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে যে ‘এসো বাবা, বোসো বাবা’ করা—সেটা কি সোশাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে হওয়া সম্ভব? জামাইদের কি এ বার মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে, ফুলের বদলে স্যানিটাইজারের টানেল পার হয়ে শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতে হবে? হাতে করে নিয়ে আসা নতুন জামা-কাপড়, দই-মিষ্টির বাক্স ও হাঁড়ি শাশুড়িমা কি হাতে নেওয়ার আগেই বোতলবন্দি সারফেস ক্লিনার দিয়ে চান করিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন? তার পর জামাইবাবাজিকে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকিয়ে, শ্যাম্পু-সাবান দিয়ে স্নান করিয়ে, টাটকা মাস্ক পরিয়ে, তবেই কি নিয়ে আসবেন ডাইনিং টেবিলে?
আরও পড়ুন: গাঁদা কিংবা গোলাপ, নানা ফুলের ব্যবহারেই জেল্লাদার ত্বক
সব কিছু কোনও রকমে পার হলেও বিজয়ার দিনটায় যে কী হবে, তা ভেবে তো কূল পাচ্ছি না! মা দুগ্গার কপালে সিঁদুর আর মুখে মিষ্টি দিয়ে যে সব তরুণীরা উঁচু সিঁড়ি থেকে নেমে আসার জন্য পাশে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক ভলান্টিয়ারদের হাত ধরে, তারা কি এ বারও সেই হাত নির্ভয়ে চেপে ধরতে পারবে? নাকি তাদের হাঁটুতে বাত ধরা বাপ-জ্যাঠা, এক-হাতে লাঠি নিয়ে, অন্য হাতে পাকড়ে ধরবে তাদের ফিনফিনে পেলব কব্জি? সিঁদুরখেলাও কি শেষটায় ভার্চুয়াল হয়ে যাবে নাকি রে বাবা! বিজয়ার কোলাকুলি সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে কী ভাবে করা সম্ভব, তা জানতে আমরা কি কোনও প্রখ্যাত মূকাভিনয় শিল্পীর কাছে একটা অনলাইন ওয়ার্কশপ করে নেব? বিজয়ার রাত্রে ভাসানের মিছিলে বেরিয়ে, ঢাকের তালে তালে যে বিখ্যাত নাচ, তা-ও কি দূরে-দূরে থেকে, মুখে মাস্ক পরে করতে-করতে যাওয়া সম্ভব? আর করলেও তাতে লুকিয়ে থাকা সহজ-সরল আনন্দটুকু কি আর আগের মতোই পাওয়া যাবে!
কার্টুন: দেবাশীষ দেব।