বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর মিথ্যে বলব না, পুজো ব্যাপারটা আমাদের কাছে যতটা ধর্মীয়, তার সমান বা হয়তো তার থেকেও বেশি সামাজিক। এই যে দশটা লোক মিলে আমোদ আহ্লাদ করছে, চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে প্রতিমা বিসর্জন- পুরো ব্যাপারটা ম্যানেজ করছে- এর মধ্যে কিন্তু একটা আলাদা আনন্দ আছে- সে আপনি যাই বলুন! আর পুজোর সময়ে দশটা ইয়ার দোস্ত মিলে যে নরক গুলজারটা আপনি করে থাকেন, সেটাকে নয় না-ই ধরলাম! তবে পুরুষদের একা দোষ দিয়ে লাভ নেই, ম্যাডামরাও এই একটা ব্যাপারে কম যান না। না তাকিয়েই বাঁকা চোখের পলকে দেখে নেওয়া যে কে কী করছে, কোন দিদি কি পরেছেন, সেটার ডিটেলস - এগুলো ম্যাডামরা যে রকম সুচারু পারদর্শিতার সঙ্গে করে থাকেন, তা করতে গেলে অনেক আচ্ছা আচ্ছা ম্যানেজমেন্ট পুরুষ গুরুর দশ বার জন্মগ্রহণ করতে হবে! সে কথা কিন্তু হলফ করে আমি এখনই বলতে পারি। তা সে যাকগে, আমার সাদা মনে কাদা নেই, আর যে কোনও বঙ্গসন্তানের মতো আমারও পরচর্চা করা মোটেই পছন্দের নয়। শুধু যা, আলোচনার সময় একটু ইয়েতে দোষ নেই। তবে দশ কথার এক কথা, পুজোর সময় যে খাওয়াদাওয়াটি হয়, আমার মতো পেটুকের কাছে তার মাহাত্ম্য মোটেই কম নয়। যাকগে, কাজের কোথায় আসি। বাঙালির কাছে সব পুজোর রাজা (নাকি রানি) হল দুর্গাপূজা। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই এখানে যে প্রচুর গল্প লুকিয়ে থাকবে তার খাওয়াদাওয়ার মধ্যে, তা বলাই বাহুল্য। আসুন একটু খুঁজে দেখা যাক।
পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পরে কলকাতার কিছু বাবু প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেন কলকাতা গ্রামে। হ্যাঁ, শহর কলকাতার তখনও পত্তন হয়নি, আর কলকাতা তখনও এক গ্রাম মাত্র। কথিত আছে, সেই পুজোয় কলকাতার কিছু বড়লোক পরিবার ছাড়া প্রবেশাধিকার ছিল কেবলমাত্র সাহেবদের। সাধারণ মানুষের সেই আমোদে সামিল হওয়ার কোনও অধিকার ছিল না। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক। সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে কলকাতার কিছু যুবক এই ব্যাপারটায় বিরক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজার প্রবর্তন করেন। কথিত আছে, এই বারো জন ইয়ারের পুজো থেকেই বারো-ইয়ারি বা বারোয়ারি পুজো শব্দটির উদ্ভব। বাবু রামচরণ রায় মহাশয়ের ‘কলকাতা বিচিত্রা’ বইতে আমরা এর উল্লেখ পাই।
দুর্গাপূজা আসলে কিন্তু বাড়ির মেয়ে বাপের বাড়ি ফেরার আমোদের বহিঃপ্রকাশ। ফলে খাওয়াদাওয়া হবে না, এটা হতেই পারে না। কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়িতে সেই সময়ে আমরা দেখতে পাই মহাভোজের ছবি। মাছ-মাংস কি না নেই সেখানে! পাঁচমিশেলি সবজি দিয়ে ঝোলের ব্যঞ্জনও তো আমরা এই সময়েই দেখতে পাই । এপার বাংলা আর ওপার বাংলায় সেই আমাদের সম্পূর্ণ আলাদা রূপ। ওপার বাংলায় যেখানে জোড়া ইলিশ আনতেই হয়, এপার বাংলায় সেখানে বরং নিরামিষ বৈষ্ণব আচরণবিধির প্রাবল্য। এর কারণ কী শ্রীচৈতন্যদেবের এ দেশে প্রভাব? হতে পারে, হয়তো না-ও হতে পারে। কিন্তু সে সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শাক্তমতে যে কোনও পুজোয় বলি অবশ্যকর্তব্য এবং তাতে দোষের কিছু নেই। তান্ত্রিকমতে অষ্টমী যখন শেষ হয় আর নবমী শুরু হয়, সেই সন্ধিক্ষণই বলির আদর্শ সময়। মা দুর্গাকে এই সময়ে চামুণ্ডারূপে পূজা করা হয়. সেই চামুণ্ডা, যিনি চণ্ড ও মুণ্ড, দুই অসুরকে নাশ করেছিলেন। কচি পাঁঠার মাংস পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া রান্না হয় ভোগ দেওয়ার জন্য। বৈষ্ণব মতে, পেঁয়াজ-রসুন শরীর গরম করে, তাই রান্নায় তার নো এন্ট্রি। কিন্তু পুজোয় ব্যবহার হয় বলে মাংসের এ ক্ষেত্রে ছাড় আছে। কালীপুজোর সময়ে এই নিরামিষ মাংসের প্রচলন আমরা দেখতে পাই। প্রাচীন কালে অব্ৰাহ্মণদের কোনও অধিকার ছিল না যে রান্না করা ভাত বা অন্ন তাঁরা ঠাকুরকে দেবেন। এ দিকে মা দূর্গা যে বাড়ির মেয়ে। দু’মুঠো ভাত তাঁকে না দিলে হয়? তাই প্রচলন শুরু হয় চাল-কলা মেখে দেওয়ার। এর সঙ্গে হরেক রকম ফলমূল আর মিষ্টি তো থাকবেই। দশমীর দিন কিন্তু আলাদা গল্প। মেয়ে সে দিন শ্বশুরবাড়ি ফিরবে, তাই বাড়িতে সব্বাইকার মন খারাপ, মুখ ভার, রান্না করার কারওরই মন নেই। ফলে আগের দিনের রান্না করে রাখা পান্তাভাত খাওয়ার রীতি, যাকে কি না বলা হয় শীতলভোগ। আর বাড়িতে সব সময়েই একটা ধারণা থাকে যে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় বাড়ির যা ভাল জিনিস, মেয়েকে তা খাইয়ে দেওয়ার। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। বাড়িতে তৈরি বড়ি, আচার ইত্যাদির প্রচলন আমরা দেখতে পাই এই সময়ে।
এত গল্পের পরে আসুন পেটুকপ্রবর, আমরা আবার একটু আধুনিক কালে ফিরে আসি। আমাদের যৌবনকালে বা কৈশোরে দুর্গাপুজো ছিল সাপের পাঁচ পা দেখার সময়। বাড়ির থেকে যে সামান্য টাকা পাওয়া যেত, একটা সময়ে সে উড়ে যেত সিংহ ব্র্যান্ড ক্যাপ আর আলুকাবলি কিনতে। যবে সামান্য জ্ঞানবুদ্ধি হল, সেটি গেল সিগারেট কিনতে। আর একটু লেজ গজালে নেশা জাগল পুজোর সময়ে অপটু হাতে নতুন শাড়ি সামলানো আর লিপস্টিক সামলে ফুচকা মুখে ফেলা প্রেমিকার লাল নাক আর হাসিমাখা চোখ দেখার। এবং হিরো সাজার চক্করে সে ফুচকার দামও বেশির ভাগ সময়ে আমারই পকেট থেকে। তবে তখন আমিই বা কে আর রাজাই বা কে? এখন শিব্রাম চক্কোত্তির মতো রিনির থেকে পাখির ছানার ন্যায় খাওয়ার সৌভাগ্য তো আর সবার হয় না… তবে আড়ালে আবডালে যে দু’চারবার চকাস করে অনভ্যাসের গন্ধমাখা আওয়াজ দু চারবার হয়নি, এই বুড়ো বয়সে সে কথা বলে পাপের আর ভাগীদার হতে চাই না। একটা কথা কিন্তু মানতে হবে, মাঝরাত্রে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে অপটু কিশোরের হাতে বানানো এগরোলে যে স্বাদ আমি পেয়েছি, সাধারণ সময়ে অনেক বড় দোকানে সে স্বাদ খুঁজে ফিরেছি পরে বহু সময়ে। এ ছাড়া সে লাল শালু ঢাকা হাঁড়ির বিরিয়ানি বা চিকেনের ছাঁটের মোমো - সে পুজো ইস্পেশাল খাবারের যে স্বাদ নেয়নি , এ জন্ম যে তার খুব সার্থক, এমন কথা খুব একটা বলা যায় না।
এখন অবশ্য বয়েস হয়ে গেছে। কমপ্লেক্সের প্যান্ডেলে সকাল থেকে বসে জ্ঞান দেওয়া আর পুজো কমিটির খাবারের খুঁত ধরা ছাড়া বিশেষ একটা কাজ নেই। কিন্তু বাকি খাবারে যা-ই হোক, অষ্টমীর সেই খিচুড়ির স্বাদ শত চেষ্টাতেও বা হাজার জিনিসেও যেন বাড়িতে আসে না। এমনকি আমার যে ছেলে এমনি সময়ে খাওয়া নিয়ে চরম নাটক করে, পুজোর সময়ে সে-ও দেখি বন্ধুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে থালা কে থালা সেই খিচুড়ি উড়িয়ে দেয়! আর সূয্যিমামা ডুবলে কোনও এক বন্ধুর বাড়িতে হালকা করে দু’টি পেগ বানিয়ে বসে ৮০'র দশকের গান চালিয়ে দুঃখবিলাসের যে কী আনন্দ, সে বলে বোঝানো যায় না। ম্যাডক্স স্কোয়ারে বা বালিগঞ্জের দুর্গাবাড়িতে বসে বয়েস আজ আর হয়তো নেই, কিন্তু কোনও বিশেষ বঁধুর থেকে দু পিস্ বেশি মাংস নিতে কিন্তু আমাদের আজও খুব একটা মন্দ লাগে না।
যাকগে, পুজোর খাওয়া দাওয়া বরাবরই বাঙালির জীবনে এক আলাদা আকর্ষণ - সে ছিল, আছে এবং থাকবে। আমার ছেলেকেও কোনও দিন নিশ্চয়ই আমি ভারী গলায় বলব যে, "বাইরে যে কোনও কিছু খেয়ো না যেন।" আর বেরিয়ে গেলে গিন্নির দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসব - অধিকন্তু ন দোষায়!
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।