চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো তার ঐতিহ্যে, আলোকসজ্জায় এবং সাবেকিয়ানায় যে খ্যাতি অর্জন করেছে, বাংলার আর কোনও অঞ্চল তা পারেনি। ইতিহাস তার সাক্ষী। তবে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন কী ভাবে হয়েছিল, তা নিয়ে রয়েছে নানা মত।
একটি তত্ত্ব বলে, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর হাত ধরে। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ এই ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ছিলেন ফরাসি সরকারের দেওয়ান।
জনশ্রুতি অনুসারে, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেন।
যদিও এ কাহিনি নিয়ে মতান্তর আছে। কারণ, ইন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয়েছিল ১৭৫৬ সালে। আর ১৭৫৬-এ কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন আদৌ হয়েছিল কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট দ্বিমত আছে গবেষকদের মধ্যেই।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মতে, এই পুজোটি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০ খৃষ্টাব্দ) শুরু করেছিলেন। তিনি নাকি কোনও এক কারণে দুর্গা পুজোর সময়ে তৎকালীন নবাবের হাতে বন্দি হন।
কারাগারে থাকাকালীন স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন পরের মাসের অর্থাৎ কার্তিক শুক্লা নবমীতে এই পুজো করার জন্য। ছাড়া পেয়ে চাঁদা জগদ্ধাত্রী সঙ্গে সূচনা করেন।
সময়কাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও ধরা হয় এই পুজো শুরু সর্বপ্রথম কৃষ্ণনগরে। এর পরে চন্দননগর বা অন্যান্য স্থানে জগদ্ধাত্রীপুজোর প্রচলন হয়।
আর একটি মত অনুযায়ী, কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ছিলেন গিরীশচন্দ্র রায়। তিনি নদিয়ার শান্তিপুরের কাছে ১০৮ ঘর ব্রাহ্ম পরিবারকে থাকতে দিয়ে একটি গ্রাম পত্তন করেন, যার নাম 'ব্রাহ্মশাসন'। তার পর থেকে শান্তিপুরে জগদ্ধাত্রী সঙ্গে প্রথা শুরু।
অন্য একটি প্রচলিত মতে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান ছিলেন দাতারাম শূর। দাতারামের বসবাস ছিল ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটি অঞ্চলে।জনশ্রুতি, এখানেই আনুমানিক ১৭৬২-নাগাদ দাতারামের বিধবা মেয়ে তাঁর বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিলেন। গবেষকেরা মনে করেন এ পুজোতেও কৃষ্ণচন্দ্রের অনুদান ছিল।
পরবর্তীকালে এই পুজোটি স্থানান্তরিত হয় শিবতলা অঞ্চলে। মাঝে আর্থিক কারণে পুজোটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে গৌরহাটি অঞ্চলের বাসিন্দারা পুজোটির দায়িত্ব নেন এবং সেই পুজোটি আজ এলাকায় পরিচিত তেঁতুলতলার পুজো নামে।
আবার আর একটি মতানুসারে, চন্দননগর আর কৃষ্ণনগরের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বহু দিনের। কৃষ্ণনগরের চাল ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট সময়ে চন্দননগর (তৎকালীন ফরাসডাঙা) থেকে চাল কিনে বাড়ি ফিরতে না পারায় ফরাসি সরকারের অনুমতিক্রমে চন্দননগরের চাউল পট্টিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর শুরু করেছিলেন। সেটিই পরবর্তীকালে এগিয়ে নিয়ে যান চন্দননগরের চাল ব্যবসায়ীরা।
চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ কাপড়পট্টির জগদ্ধাত্রী পুজো এখানকার দ্বিতীয় প্রাচীনতম পুজো। কথিত, ১৭৬৮ সালে চাউলপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় (মতান্তরে শশধর) রীতিমতো চাঁদা তুলে নাকি এই পুজোর প্রবর্তন করেছিলেন। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য পুজোগুলির মধ্যে রয়েছে লক্ষ্মীগঞ্জ চৌমাথা ও লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের পুজোও।