তিনিও হর-পার্বতীর পুত্র। কিন্তু তাঁর ভাগ্য কার্তিক বা গণেশের মতো নয়। ‘শিব পুরাণ’-সহ বেশ কিছু পুরাণ এবং রামায়ণ ও মহাভারতে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর কাহিনি। ভাগ্যবিড়ম্বিত এক বীর তিনি। তাঁর নাম অন্ধক।
‘শিব পুরাণ’ থেকে জানা যায়, একদা মন্দার পর্বতে ধ্যানমগ্ন শিবের সঙ্গে কৌতুক করে পার্বতী তাঁর চোখগুলি চেপে ধরেন। শিবের চোখ বন্ধ হওয়ায় ত্রিভুবন জুড়ে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। শিব ঘামতে শুরু করেন। তাঁর ঘামে পার্বতীর স্পর্শ পড়তেই তা থেকে জন্ম নেয় এক পুত্রসন্তান। সে ভীষণদর্শন এবং অন্ধ। পার্বতী তাকে দেখা মাত্রই পরিত্যাগ করতে চান। কিন্তু শিব তাঁকে বোঝান, সে যে হেতু তাঁদের দু’জনের স্পর্শে জন্মেছে, সে হেতু সে তাঁদের সন্তান। তাকে পরিত্যাগ করা যাবে না। শিশুটির নাম রাখা হয় অন্ধক। অর্থাৎ ‘যে অন্ধকারকে সৃষ্টি করে’।
অন্য দিকে, দানবরাজ হিরণ্যাক্ষ তখন সন্তান কামনায় শিবের তপস্যা শুরু করেছেন। শিব তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে অন্ধককে দান করলেন। হিরণ্যাক্ষ পরে দেবতাদের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধে রত হন এবং বিষ্ণু বরাহ অবতারে তাঁকে বধ করেন।
হিরণ্যাক্ষের মৃত্যুর পরে অন্ধক দানবদের সিংহাসনে বসেন। তাঁকে দেবতারা অসুর বা দানব হিসেবে ভাবেননি। কারণ, তিনি হর-পার্বতীর মতো দেবদম্পতির সন্তান। আবার অসুররা তাঁকে একই কারণে মানতে অস্বীকার করে। অন্ধক নিজের জন্মবৃত্তান্ত না জেনে শুধুমাত্র অসুরদের অবহেলার কারণে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা তাঁকে দিব্যদৃষ্টি ও অমরত্ব দান করেন। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও বলেন যে, একমাত্র শিবই তাঁর মৃত্যুর কারণ হতে পারেন। অন্ধক অপরাজেয় হয়ে দানবলোকে ফেরেন এবং দেবতাদের বিরুদ্ধে হিরণ্যাক্ষের অসমাপ্ত সংগ্রাম নিজের হাতে তুলে নেন।
এক সময়ে অন্ধক তাঁর মন্ত্রীর কাছে জানতে চান, ত্রিভুবনে এমন কে আছেন, যিনি শৌর্য-বীর্য-সম্পদে তাঁর থেকেও গরীয়ান? মন্ত্রী তাঁকে জানান, একমাত্র শিবই তাঁর থেকে গরীয়ান। কারণ তিনি ত্রিভুবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী পার্বতীর স্বামী। অন্ধক তাঁর জন্মের প্রকৃত বৃত্তান্ত না জেনেই শিবকে জানান, তিনি যেন পার্বতীকে পরিত্যাগ করে অন্ধকের হাতে তুলে দেন। এর পর তিনি কৈলাস আক্রমণ করেন। কিন্তু শিবের বাহিনী দানব সেনাদের পরাস্ত করে।
এক দিন শিব ও তাঁর সঙ্গীরা কৈলাসের বাইরে ছিলেন। অন্ধক পার্বতীকে একা পেয়ে কামার্ত হন। পার্বতী অন্ধকের আক্রমণ প্রতিহত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন দেখা গেল যে, অন্ধক কিছুতেই নিরস্ত হচ্ছেন না, পার্বতী অন্য দেবতাদের শরণ নিলেন। বছরের পর বছর ধরে দেবাসুরের যুদ্ধ চলতে লাগল। কিন্তু অন্ধক পার্বতীকে জয় না করে থামবেন না বলেই জানালেন।
অন্ধকের সেনাপতি বলী একাই দেবতাদের পরাজিত করতে লাগলেন এবং তিনি দেবতাদের গিলে ফেললেন। বলীকে প্রতিহত করতে শিব অতিরিক্ত শক্তিশালী অস্ত্রের প্রয়োগ করলে বলী দেবতাদের উগরে বার করে দেন। শিব এ বার দানবগুরু শুক্রাচার্যকে গিলে ফেলেন। অন্ধক রাগে দেবরাজ ইন্দ্রকে আক্রমণ করেন। (সঙ্গের ছবিটি বামনাবতারের সামনে বলী ও শুক্রাচার্যের)
এ বার শিব নিজে প্রবেশ করেন রণক্ষেত্রে এবং অন্ধকের উপরে ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করেন। ত্রিশুলের আঘাতে অন্ধকের দেহ থেকে রক্ত ক্ষরিত হলে প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে জন্ম নিতে থাকে একেকটি ভয়ানক দানব। তাদের সংহারের জন্য শিব বিভিন্ন মাতৃকাকে তৈরি করেন। মাতৃকারা দানবদের রক্ত ভূমি স্পর্শ করার আগেই তা খেয়ে ফেলে দানবদের জন্ম রোধ করেন। এর পর শিব অন্ধককে চরম আঘাত করেন। (সঙ্গের ছবিটি ‘হরিবংশ’-এর ফারসি অনুবাদের চিত্রায়ন থেকে)
মৃত্যুকালে অন্ধককে শিব তাঁর প্রকৃত জন্মবৃত্তান্ত জানান। অনুতপ্ত অন্ধক তিন বার শিবের নাম করে মারা যান। কিন্তু যে হেতু তিনি ব্রহ্মার বরে অমর, তাই আবার তাঁকে বেঁচে উঠতে দেখা যায়। শিব তাঁকে তাঁর ‘গণ’ বা অনুচরদের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। অন্য মতে, শিব তাঁর তৃতীয় নয়নে তাঁকে দগ্ধ করে হত্যা করেন।
অন্ধকের এই কাহিনি অন্য ভাবেও উল্লিখিত হয়েছে অন্যান্য পুরাণে। কোথাও তাঁকে অন্য দেবতা বা প্রাকৃতিক শক্তির সন্তান হিসেবেও দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাকি কাহিনি ‘শিব পুরাণ’-এর মতোই। এখানে মনে রাখা দরকার, শিব ও তাঁর ‘শক্তি’ পার্বতী— দু’জনেই আদিতম অস্তিত্বের প্রতীক। এখানে শিবের চোখ ঢেকে দেওয়া ও তার কারণে অন্ধকের অন্ধত্বও যেন অন্য কোনও রহস্যের ইঙ্গিত দেয়। মহাশক্তির অন্ধত্ব যেন জমাট বেঁধে ভয়ঙ্কর এক দানবের রূপ নিচ্ছে, যাকে তার মা পর্যন্ত সহ্য করতে পারছেন না।
অন্ধকের মাতৃগমনের ইচ্ছের সঙ্গে মিলে যেতে পারে গ্রিক পুরাণে উল্লিখিত ওইদিপাউসের কাহিনি। সেখানেও মাতৃগমন ও অন্ধত্ব নিবিড় সম্পর্কযুক্ত ছিল। ভারতীয় পুরাণের অন্ধক আর গ্রিক পুরাণের ওইদিপাউস কোথায় একাকার হন? পুরাণবিদরা দেখান, এর মধ্যেও রয়েছে গূঢ় রহস্য। কখনও সে রহস্য বাসনার সঙ্গে অবচেতনের সম্পর্ক। আবার কখনও তা জ্ঞান ও ক্ষমতার জটিল সম্পর্কের মধ্যে বাস করে। (সঙ্গের ছবিটি অন্ধ ওইদিপাউস ও তাঁর কন্যা আন্তিগোনের)
হর-পার্বতীর বাকি দুই পুত্রের জন্মও কিন্তু সে অর্থে ‘স্বাভাবিক’ নয়। গণপতি জন্মেছিলেন পার্বতীর গায়ের ময়লা থেকে। আর মহাভারত অনুসারে কার্তিকেয় জন্মান শিবের স্খলিত বীর্য থেকে। সেই বীর্য ধারণ করেন গঙ্গা। সেই ভ্রূণকে তাপ দেন অগ্নি। জন্মলাভ করে কার্তিকেয় গঙ্গার তীরেই পড়ে ছিলেন। সুতরাং, অন্ধকের মতো তাঁরাও ‘অ-স্বাভাবিক’। তা হলে অন্ধকের জীবন কেন এত বেদনার হল? সে ‘অন্ধকারের সন্তান’ বলে? উত্তর মেলে না।