একটা ফুটবল ম্যাচ কীভাবে শারদীয়ার আনন্দ ঘেঁটে দিতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ আছে পাহাড়ে!
সালটা ১৯৮০। সেবারের দার্জিলিং গোল্ড কাপের ফাইনাল পড়েছিল মহাষষ্ঠীতে। তা’ও কিনা সেটা মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল ডার্বি ম্যাচ। ঠিক যেমন এবছর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সন্ধেয় পড়েছে আইএসএলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান বড় ম্যাচ। ৩৩ বছর আগে অবশ্য পাহাড়ে দুর্গাষষ্ঠীর দুপুর-দুপুর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সবুজ-মেরুন আর লাল-হলুদের মহারণ হয়েছিল।
সেই ১৯৮০! ময়দানের ফুটবলের অভিশপ্ত বছর! সেবার ময়দানে মরশুম শুরুই হয়েছিল বড় টুর্নামেন্ট দিয়ে। একেবারে ফেডারেশন কাপ! মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ম্যাচ ১-১ শেষ হলে সংগঠকেরা আর অতিরিক্ত সময় এমনকী সরাসরি টাইব্রেকারে ফাইনালের মীমাংসা করারও ঝুঁকি নেননি।
হয়েছিল কী, এই ক'দিন আগে প্রয়াত ময়দানের বড়ে মিঞা মহম্মদ হাবিবের গোলে সেদিন ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে যেতে এক অতি অত্যুৎসাহী লাল-হলুদ সমর্থক মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন মালা হাতে। কিন্তু হাবিবকে মালা পরিয়ে ফেরার পথে বিপক্ষের সুব্রত ভট্টাচার্যকে কটুক্তি করেন তিনি। চির মোহনবাগানী বাবলু উত্তেজিত হয়ে সেই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের দিকে পা চালান। তারপর বাকি ম্যাচে গোটা ইডেন গ্যালারি উত্তাল ছিল। কোনও ক্রমে রেফারি নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষের বাঁশি বাজালে তৎক্ষণাৎ দুই প্রধানকে সেবারের ফেডারেশন কাপে যুগ্মজয়ী ঘোষণা করে হাঁফ ছাড়েন সংগঠকেরা।
এর কয়েক মাসের মধ্যেই সেই ভয়ঙ্কর ১৯৮০-র ১৬ আগস্ট! ইডেনের রঞ্জি স্ট্যান্ডে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বড় দলের সমর্থকদের মধ্যে খন্ডযুদ্ধ লেগে যায়। পদপিষ্ট হয়ে ১৬ জন দর্শক মারা যান। যে মর্মান্তিক ঘটনায় ১৯৮০ সালে তারপর ময়দানে লিগ এবং আইএফএ শিল্ড, দুই-ই আর হয়নি।
সেই বছরের দুর্গাষষ্ঠীতে দার্জিলিংয়ে মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল গোল্ড কাপ ফাইনালের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এবং ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝিও যখন মোহনবাগান ২-০ গোলে এগিয়ে, পাহাড় থেকে সাগর গোটা পশ্চিমবঙ্গের সবুজ-মেরুন সমর্থকেরা বোধহয় আগাম পরিকল্পনা সেরে ফেলেছিলেন, দুগ্গাষষ্ঠীর সন্ধেটা কী বিশেষ আনন্দোৎসব করবেন, কীভাবে করবেন!
ও দিকে দার্জিলিংয়ের মাঠে তখন মোহনবাগান কোচ ইস্টবেঙ্গল-জয় কার্যত নিশ্চিত বোধহয় ধরে নিয়ে শ্যাম থাপাকে তুলে নেন। মাঠ থেকে বেরনোর সময় শ্যাম তাঁর সামনে থাকা কয়েকজন সতীর্থ সবুজ-মেরুন ফুটবলারদের বলেন, ‘পারলে ওদের জালে আরও দুটো ভরে দিস্।’
কথাটা মাঠের ওখানেই দাঁড়ানো সুধীর কর্মকারের কানেও গিয়েছিল। তাঁর বিখ্যাত লাল-হলুদ সতীর্থ ফুটবলারের ওই মুহূর্তে করুণ হয়ে ওঠা মুখ দেখে মজিদ বাসকর দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘সুধীরদা, হোয়াত্ দিদ্ শ্যাম সেইদ্?’
মজিদকে শ্যামের ফোড়নকাটা কথাটা সুধীর বলতে লাল-হলুদের ইরানিয়ান শিল্পী ফরোয়ার্ড শুধু বলেছিলেন, ‘ওকে, আই উইল সী!’
আর তার পরের আধ ঘন্টা মোহনবাগান রক্ষণে দার্জিলিংয়ের ঠান্ডার কাঁপুনির চেয়েও বেশি কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন মজিদ। ০-২ থেকে ৩-২ করে মোহনবাগানকে হারিয়ে সে দিন ইস্টবেঙ্গলের দার্জিলিং গোল্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে লাল-হলুদের তিনটে গোলেরই কারিগর একজনই মজিদ বাসকর। তিনটে গোলের ফাইনাল পাস-ই ছিল অনন্য মজিদের বাড়ানো সেদিন।
তারপর কাপ নিয়ে ড্যাং-ড্যাং করে এক দিকে ইস্টবেঙ্গল দল তো মহাসপ্তমীতে কলকাতায় এসে পুজোর আনন্দে বাড়তি মেতে উঠেছিল সেবার। কিন্তু সুব্রত ভট্টাচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম সরকার এমনকি শ্যাম থাপা, গোয়ান ফ্রান্সিস ডি'সুজা-র মতোও এক ঝাঁক মোহনবাগান ফুটবলার পুজোর দিনে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের হাতে অমন চরম অপ্রত্যাশিত হারের দুঃখে পুজোর বাকি ক'টা দিন কলকাতাতেই ফেরেননি। দার্জিলিংয়েই রয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি হোটেলের ঘর ছেড়েই বেরোননি বিজয়া দশমী পর্যন্ত। পাহাড়ের পুজো প্যান্ডেলে যাওয়া, ঠাকুর দেখা তো দূর অস্ত! তেত্রিশ বছর পরে আজও পুজোর মুখে সুব্রত-গৌতম-শ্যামদের জিজ্ঞেস করলে ওঁরা এখনও বলেন, ‘উফ! সে এক দুঃখের দুর্গাপুজো গিয়েছিল বটে!’
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।