পুজোর সঙ্গে সবসময়েই পড়াশোনাহীন ছুটির একটা যোগ রয়েছে। সে ছুটি ফাঁকির ছুটি নয়। বরং যেন প্রাপ্য।
এমন একটা বাড়িতে, এমন একটা পরিবেশে বড় হয়েছি, যেখানে পুজো-কেন্দ্রিক একটা বিশেষ সংস্কৃতিকে অনুভব এবং আত্মস্থ করে নিতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। এই সংস্কৃতিটা মূলত এই পাঁচ দিনের অনাবিল আনন্দের। তাই ‘পুজো’ শব্দের অর্থ আমার কাছে খুবই সহজ- ‘পুজো আসছে’ থেকে শুরু করে একেবারে কালীপুজো পর্যন্ত একটা প্রচণ্ড উদ্দীপনা এবং উল্লাস যাপন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে আমার পুজোর সংজ্ঞা। ছোটবেলায় যেমন পুজো মানেই ছিল একটা লম্বা ছুটি। পড়াশোনার পাট চুকে যেত তৃতীয়া-চতুর্থীর দিন। ‘হাফ ইয়ার্লি’ পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুজো শুরু হয়ে যেত আমাদের। তাই পুজোর সঙ্গে সবসময়েই পড়াশোনাহীন ছুটির একটা যোগ রয়েছে। সে ছুটি ফাঁকির ছুটি নয়। বরং যেন প্রাপ্য।
আমার অনেক ছবির সঙ্গে পুজোর যোগ রয়েছে। এটা ভবিতব্য ছিল, এমন বিশ্বাস করি না ঠিকই। তবু পুজোর এই অভিজ্ঞতাগুলো বড্ড আপন মনে হয়।
‘পুজো’ এবং ‘ছুটি’র এই একে অপরের প্রতি অমোঘ টান বড়বেলাতেও স্পষ্ট ভাবে রয়ে গিয়েছে। সারা বছর বিভিন্ন কাজ থাকে। কিন্তু পুজোর দিনগুলোয় আমি কখনও কোনও কাজ রাখি না। শহরের পুজো দেখেই বড় হয়েছি। এই পাঁচটা দিন বাকি সব কিছুর চেয়ে আলাদা। এমনকি করোনার এই দু’বছরেও, যেখানে বাকি সব কিছু এতটাই ম্লান, সেখানে দাঁড়িয়েও পুজো নিজের দৈনন্দিন রুটিন থেকে বেরিয়ে একটা অন্য ধরনের যাপনে যাওয়ার সুযোগ। যেখানে রোজ সকালে উঠে যা হোক কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়তাম, সেখানে এই পাঁচটা দিন সকালে উঠে সবার সঙ্গে বসে লুচি আর ছোলার ডাল। এই ছোট্ট ছোট্ট ব্যতিক্রমগুলোই আমার কাছে পুজোর সব থেকে বড় আনন্দগুলোর একটা। দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় ক্লান্তির শেষে মনের ভিতরে একটা অদ্ভুত ছুটির ছটফটানি।
এই একটা কথা খুব গর্ব করে বলতে পারি- দুর্গাপুজো শুধু কলকাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতবর্ষ ছাপিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত বাঙালির উৎসব। জায়গা বা সময়ের ভিত্তিতে আলাদা হলেও সকলেই একটা বৃহত্তর পরিবারের অংশ। হয়তো দশমীর পরের দিনই প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে, কিন্তু দশমী অবধি যেন এই আন্তরিকতা, ভালো লাগাটা আমাদেরকে ঘিরে থাকে।
আমরা কিন্তু একটা অদ্ভুত প্রজন্ম। আমরা ল্যান্ডলাইন ফোন পেয়েছি, আবার ওয়াইফাই-ও পেয়েছি। ইন্টারনেট-হীন ছোটবেলায় সারা বছর যে বান্ধবীকে বাড়ির ল্যান্ডফোনে পাওয়া যেত না, পুজোর মণ্ডপে ঠিক দেখা হয়ে যেত তার সঙ্গে। অষ্টমীর দিনই ছিল বলার সুযোগ, ‘বেরোবি আমার সঙ্গে?’ সে বেরনো হয়তো বড়জোর আইসস্ক্রিম খেতে যাওয়া বা পাশের পাড়ার পুজো দেখা। পরবর্তীতে পুজোর সময়ে প্রেমটা একটা ভীষণ রোমহর্ষক ব্যাপার ছিল। একসঙ্গে ঠাকুর দেখা, মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানো, সে এক আলাদা উত্তেজনা!
এক পুজোতেই আমার প্রথম ছবি ‘কহানি’র কাজ হয় কলকাতায়। আমার বলিউডের প্রথম কাজ, বিদ্যা বালনের সঙ্গে প্রথম কাজ, সবটারই শুরু পুজোয়। মা খুব খুশি হয়েছিল তাতে। ‘কহানি’র সেটে আমার শেষ দিন, ২০১০ এর অক্টোবরের ১২ তারিখ। তার পরদিন আমার জন্মদিন ছিল। সে দিন কাজের শেষে সবাই মিলে কেক কাটা হল। নিজের শহর, তার উপর পুজো, আমার প্রথম কাজ, জন্মদিন, সব মিলিয়ে এই স্মৃতি আমার খুব কাছের।
এ ছাড়াও আমার আরও অনেক ছবির সঙ্গে পুজোর যোগ রয়েছে। ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ-এর একটা দৃশ্যের কাজ আমরা ষষ্ঠীর দিনেই করেছিলাম। পুজোয় কাজ করেছি ‘দুর্গা সহায়’-এরও। এটা ভবিতব্য ছিল, এমন বিশ্বাস করি না ঠিকই। তবু পুজোর এই অভিজ্ঞতাগুলো বড্ড আপন মনে হয়।
ক্রমাগত নেতিবাচক অনুভূতির মধ্যেও কোথাও যেন ভাল কিছুর অনুঘটকের মতো কাজ করে পুজো।
শেষ দু’বছরে পুজোর সংজ্ঞা অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। গত বছর বাঙালির সংযমের পরিচয় পেয়েছিলাম। জোর করে মণ্ডপে ঢোকার চেষ্টা না করে স্বাস্থ্যবিধি এবং বৃহত্তর পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে আমরা সকলে যে সংযমটা দেখতে পেরেছিলাম, তা নিঃসন্দেহে বাড়তি পাওনা। উৎসবের চেনা ছবি বদলে যাওয়ায় মন খারাপ হয়েছে। তবু নিজেকে বুঝিয়ে ফেলেছি, এবারও হয়তো তেমনই হবে। মণ্ডপে আর আড্ডা হবে না। হবে কারও বাড়িতে হবে। এখন একটাই চাওয়া। পুজোর চিরপরিচিত চেহারা যেন দ্রুত ফিরে আসে।
তবু এত কিছুর পরেও, ক্রমাগত নেতিবাচক অনুভূতির মধ্যেও কোথাও যেন ভাল কিছুর অনুঘটকের মতো কাজ করে পুজো। তাই হাজার খারাপের মধ্যেও তার জন্য দিন গোনা। শহর যে সেজে উঠছে আবার, তাতেও তো সেরে ওঠার মতোই একটা ভাল লাগা থাকে!