লন্ডন শারদোৎসব
চারিদিকে শরতের আলো , কাশফুল। এবারের অচেনা দুর্ধর্ষ গরম কমে গিয়ে বাতাসে এখন হিমের ছোঁয়া। দুরুদুরু বক্ষে রাণীমা’র শহর অপেক্ষা করছে শীতের প্রহরের। তার মধ্যেই এসেছে চিরকালের চেনা বাঙালির আপন উৎসব, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কার্নিভ্যাল। এবার লন্ডনের সব পুজোতেই থিম হবার কথা ছিল স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের। কিন্তু কেমন যেন তার সঙ্গে রাণীমা’র জীবনাবসান স্বাভাবিক ভাবেই জুড়ে গিয়েছে। রাণীমা কে দেশের মানুষ ভালবাসে, তাই ইউকে প্রবাসী বাঙালির মনের মণিকোঠায় ও স্থান নিয়েছেন অশীতিপর কর্তব্যপরায়ণ রাজমাতা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে রাণীমা এবার সকলের মননে থাকবেন।
লন্ডনের স্লাও শহরে আড্ডা এমনই একটি প্রবাসী ক্লাব যাদের এই বছর দশ বছর পূর্তি। আর থিম হল দশে দশ। বছরভর দশটি বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করছে তারা। এবারের মূল আকর্ষণ তাদের মূর্তি। হাওড়ার বাকসাড়ার শিল্পী গৌরব পালের আর্টের ঠাকুর ভিসা পাসপোর্টের চক্কর পেরিয়ে এবার প্রথম বার লন্ডনে এসে পড়লেন। হৈ হৈ করে স্লাও ক্রিকেট ক্লাবে বাঁধা হয়েছে প্যান্ডেল। কলকাতার মত মন্ডপসজ্জা না হলেও তার থেকে কম কিছু নয়! বাংলার লোকায়ত শিল্পকে পুজোর তোরণে ব্যবহার করে লন্ডনে নতুন ধারার জন্ম দিল আড্ডার পুজো। দিনাজপুরের বাঁশের পুতুল, পুরুলিয়ার ছৌ মুখোশ এবং কালীঘাটের পটচিত্রের দেখা পাওয়া যাবে এই পূজোর তোরণে। এছাড়া বাউল ও লোকগানের শিল্পীরাও পাড়ি দিচ্ছেন কলকাতা থেকে। আড্ডা কি কখনও খাওয়া-দাওয়া ছাড়া হয়? তাই প্রচুর স্থানীয় মানুষ স্টল দেবেন, কলকাতার স্ট্রিটফুডের গন্ধে ম ম করবে লন্ডনের পুজো প্যান্ডেল। মনে হবে যেন আস্ত কলকাতাটা স্যুটকেসে ভরে নিয়ে এসেছে টেমসনগরী। তাই এবারের পুজোর থিম হল আড্ডায় আড্ডা জমানো।
লন্ডন শারদোৎসব
নবপত্রিকা স্নান পুকুর বা গঙ্গার ঘাটে আমরা তো সব সময়ই দেখে থাকি। কিন্তু তাই বলে টেমসের ঘাটে নবপত্রিকা স্নান? আপাতত লন্ডন তো বটেই ইউরোপের মধ্যে সবথেকে বড় পুজো এটি। পুজোকে সর্বজনীন করে তোলার আদর্শকে মাথায় রেখেই লন্ডনের মেয়ে বউরা মিলে প্রায় ষাট জনের একটি দল পূজোর খুঁটিনাটি সাজিয়ে দেয়। আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলির সেই ছোটবেলার পূজোতে যেমন ফুলপিসি, নতুনকাকিমা, ছোড়দিদা -রা থাকতেন, তেমনই বিদেশেও এভাবেই গড়ে ওঠে সংযুক্ত পরিবার। তাদের হাতের জাদুতে ফুটে উঠবে একশো আট পদ্ম, জ্বলে উঠবে প্রদীপ, শাঁখের শব্দে উলুধ্বনিতে পালিত হবে কুমারী পুজো, বরণ, সিঁদূর খেলা।
দশমীর দিন বিশাল জলের পরাতের উপর বসবে আয়না, পাটভাঙা ধুতি, শাড়ি পরে বাঙালি বাবুরা দর্পণে পা দেখবেন মা দুর্গার। আলতা পরা মা জননীর পায়ে একটাই মিনতি মা গো আর কোন নতুন বিপদ যেন না আসে। ‘হর রোগম হর শোকম হর মারীম হরপ্রিয়ে…।’ অতিমারী সারা পৃথিবীকে ছারখার করে দিয়েছে – এবার অন্তত রোগ শোক দুঃখ থেকে মুক্তি দিও মা! গানবাজনা ছাড়া পুজোর সন্ধ্যে ভাবাই যায় না। একদিকে ধূপ ধূনোর গন্ধে আলোয় ঝাপসা হয়ে আসবে মহিষমর্দিনীর মুখ , মাইকে বাজবেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর একদিকে তুমুল ঢাকের ডুমডুমাডুম আওয়াজ। সব থেমে গেলে জমাটি আসর বসবে গানবাজনার।
প্রবাসে পুজো
লন্ডনের বাসিন্দাদের মধ্যেও প্রতিভা কিছু কম নেই,। সপ্তাহান্তে ৮ ঘন্টা করে মহড়া দিচ্ছে লন্ডন শারদ উৎসবের সদস্যরা। পরের প্রজন্মও এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে । ওদের হাতে ব্যাটন তুলে দিতে তো হবেই – খোকাখুকুর দলবল আর হাট্টিমাটিমটিম নামের প্রোগ্রাম হবে । করবে এই সব কচিকাঁচারাই। ওদেরই তো পুজো। এক টুকরো ছেলেবেলা মনের মাঝে সারা জীবন সাজিয়ে চলবে ওরা। কচি হাতে অঞ্জলি দেবে –পুরোহিতের উদাত্ত গলায় চন্ডীপাঠ শুনবে। শব্দগুলোর মানে না বুঝলেও এটাই যে শারদোৎসব – পুজোর গন্ধ সেটুকু মনে থেকে যাবে।
লুচি, আলুর দম, খিচুড়ি, লাবড়া এসব তো আছেই। তা ছাড়াও বিখ্যাত বাঙালি শেফ কিশোর দাসের স্টলে থাকবে এগরোল, ভেজিটেবল চপ, আর জিভে জল আনা চাইনিজ খাবার। বারোয়ারি পুজোর আস্বাদ নিতে হলে ইলিং টাউন হলের পূজোয় না এসে পূজো সমাপন হবে না।
লন্ডনে এখন অনেক পুজো, অনেক ধূমধাম। পুজোর দিন গুলি মনে করিয়ে দেবে প্রবাসী বাঙালির মিলন বিরহের চির চেনা উপাখ্যান। অভিমানী স্ত্রী সিঁদূর খেলার অবসরে ছুঁয়ে নেবে মনে মনে তার স্বামীকে অথবা বছরে মাত্র একবারই যাদের সঙ্গে দেখা হয় পুজো প্যান্ডেলে সেই সব বন্ধুত্ব ঝালিয়ে নেবে টেমসপারের বাসিন্দারা।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের অংশ।