রাস্তার নামকরণের সঙ্গে ইতিহাসের পাশাপাশি জড়িয়ে থাকে ভূগোল। তার অন্যতম উদাহরণ ক্রিক রো। মধ্য কলকাতার এই পথে সময় যেন অনেকটাই থমকে আছে। চারপাশের ব্যস্ততা এই রাস্তায় পা রাখতে বোধহয় সাহস পায়নি। প্রোমোটারের হাতকে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে রাস্তার বেশ কিছু বাড়ি। আর পেরেছে নিজের নামের সঙ্গে কলকাতার প্রাচীন অবস্থানের সাক্ষ্য বয়ে নিয়ে যেতে। তার নামের সঙ্গেই বয়ে চলেছে সেই খাঁড়িপথ, যা সুদূর অতীতে ছিল কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ জলপথ।(ছবি: আর্কাইভ)
‘ক্রিক’ কথার অর্থ খাঁড়ি। এখন খাঁড়ি শুনলেই আমাদের মনে হয় সুন্দরবনের কথা। কিন্তু খাস কলকাতার বুকে আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে সক্রিয় ছিল এক খাঁড়ি। তার জন্ম হয়েছিল গাঙ্গেয় বদ্বীপের অংশ হিসেবেই। চাঁদপাল ঘাট থেকে তার গতিপথ ছিল বিদ্যাধরী নদী। মাঝে সে ছুঁয়ে যেত যে জনপদগুলি, তাদের বর্তমান নাম হেস্টিংস স্ট্রিট (আজকের কিরণশঙ্কর রায় রোড), ওয়াটারলু স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট এবং প্রিন্সেপ স্ট্রিট। এরপর ধর্মতলার উত্তর দিক হয়ে সে ঢুকে পড়ত আজকের সল্টলেকে। তার পরের গন্তব্য বিদ্যাধরী নদী।(ছবি: আর্কাইভ)
সেই বিদ্যাধরীও আজ আগের মতো নেই। মজে গিয়েছে অনেকটাই। হারিয়ে গিয়েছে সে দিনের সেই খালও। তার স্রোত নাকি রয়ে গিয়েছে বেলেঘাটা খাল হয়ে। আরও একটি জায়গায় ‘রয়ে গিয়েছে’ সেই খাঁড়ি। ‘ক্রিক রো’-এর নামে। তার নামেই এই পথের নামকরণ। কারণ সেই খাঁড়ি বুজিয়েই এই পথের জন্ম। কলকাতা-গবেষকদের দাবি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই খাঁড়ির বিলুপ্তির কারণ। (ছবি: নির্মলচন্দ্র কুমারের সংগ্রহ থেকে)
সেই বিপর্যয় ঘটেছিল ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর। শেষ বর্ষার গভীর রাতে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে এসেছিল বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়। ঝড় থামতেই শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। বিপদের আকার আরও ভয়াবহ করতে সঙ্গে ছিল ভূমিকম্পও। সারা রাত ধরে দুর্যোগ চলেছিল। সকালে কলকাতা জুড়ে শুধু ধ্বংসচিহ্ন। কাঁচা বাড়িঘরের তো কোনও চিহ্ন ছিল না। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল শহরের বড় বাড়িগুলিও।(ছবি: আর্কাইভ)
আজ যেখানে মহাকরণ, সেখানে ছিল সেন্ট অ্যানের গির্জা। ইংরেজদের তৈরি সেই আদি উপাসনাস্থল চুরমার হয়ে ভেঙে পড়েছিল। কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছিল কুমোরটুলির গোবিন্দরামের মন্দিরের মূল পঞ্চরত্ন চূড়া। দাপুটে গোবিন্দরাম ছিলেন সে কালের একজন ধনকুবের। তার তৈরি মন্দিরের আর এক নাম ছিল ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’। শোনা যায়, উচ্চতায় তা ছিল অক্টারলোনি সৌধের থেকেও দীর্ঘ। (ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া)
গঙ্গার তীব্র জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গঙ্গার ঘাটগুলি। দেশীয় ডিঙি নৌকোর পাশাপাশি উধাও বিদেশি বণিকদের জাহাজও। ঝড়ের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে শোনা যায়, গঙ্গা থেকে একটি বজরা এসে আটকে যায় সেই (ক্রিক রো-এর) খাঁড়িতে। এর থেকেই এলাকার নাম ডিঙাভাঙা লেন। আঠারো শতকে ব্রিটিশদের তৈরি কলকাতার মানচিত্রে এই অঞ্চলকে ‘ডিঙাভাঙা’ হিসেবেই দেখানো হয়েছে।(ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া)
অর্থাৎ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দু’টি পরিবর্তন হল। প্রথমত, প্রাচীন খাঁড়ি হারিয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, এলাকাটি নতুন নাম পেল। তবে পরবর্তীকালে খাঁড়ি বোজানোর কাজে মানুষেরও যথেষ্ট অবদান ছিল বলে মনে করা হয়। খাঁড়ি হারিয়ে গেলেও তার অস্তিত্ব রয়ে গেল এলাকার ‘ডিঙাভাঙা’ এবং পরে ‘ক্রিক রো’ নামে। কলকাতার ইতিহাসে আরও একটি খালের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার নাম ‘বৌরানি খাল’।(ছবি: আর্কাইভ)
অনেকের মত, ডিঙাভাঙার খাঁড়িকেই সংস্কার করেছিল ব্রিটিশরা। তারপর তার নাম হয়েছিল ‘বৌরানি খাল’। ডিঙাই হোক বা খাল, এই জলপথ ছিল যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। মূল হুগলি নদীতে জলদস্যুর উপদ্রব থাকায় বণিকরা এই খাঁড়িকেই বেছে নিতেন। সওদাগরদের ডিঙি পাড়ি দিত সোজা হুগলির সপ্তগ্রাম বা পূর্ববঙ্গের ঢাকা। মাঝপথে চাঁদনির চকে বিকিকিনি চলত তাদের। (ছবি: শাটারস্টক)
খাঁড়ির উপরেই ছিল দু’টি বা তিনটি সাঁকো। আঠেরো শতকের শুরুতে সেই সাঁকো দিয়ে দিনভর চলত লোক পারাপার। আজ যেখানে হেস্টিংস স্ট্রিট, সেখানে যে সাঁকো ছিল, সেটি দিয়ে সন্ত জনের গির্জা থেকে গোবিন্দপুর অবধি যাতায়াত করা হত। এই খাল ছিল সাবেক কলকাতার সীমারেখা। এর দক্ষিণে ছিল গোবিন্দপুর। অনেকের মতে, এই খাঁড়ি বা ‘খাল কাটা’ থেকেই ‘কলকাতা’ নামের উঠপত্তি।(ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া)
যাতায়াতের মাধ্যমের পাশাপাশি এই খাঁড়ি ছিল মাছ ধরার প্রধান জায়গা। এখান থেকে জেলেরা মাছ ধরে বিক্রি করতেন সংলগ্ন বাজারে। জেলেরা জানবাজার এবং ফেনরিক বাজারে মাছও বিক্রি করতেন। তারও ইতিহাস রয়েছে। জেলেপাড়া, সারেঙ্গা লেন-এর মতো রাস্তার নামে রয়েও গিয়েছে সেই ইতিহাসের পরিচয়।(ছবি: শাটারস্টক)
ইতিহাসবিদের মতে, যে খাঁড়ি বা খাল বুজিয়ে আজকের ক্রিক রো-এর জন্ম, সেই খালই আদপে ‘গাঙুর’। যে জলপথ বেয়ে লখিন্দরের নিথর দেহ নিয়ে এগিয়েছিল বেহুলার ডিঙি। আবার কলকাতার চালু মেট্রোরেলের লাইনের নীচে গড়িয়া-বৈষ্ণবঘাটা লাগোয়া আদিগঙ্গার খালকেও বেহুলার ভেসে চলার গাঙুর বলে মনে করেন অনেকেই।(ছবি: শাটারস্টক)
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কলকাতার নীচে শাখাপ্রশাখার মতো বিছিয়ে আছে প্রাচীন জলধারার রেখা। শহরের জমির নীচে চার পাঁচ কিলোমিটারের পলিস্তর। তার পরেই অস্তিত্ব অসংখ্য ‘প্যালিয়ো চ্যানেল’ বা প্রাচীন জলখাতের। পাশাপাশি আছে ভূমিকম্পনপ্রবণ স্তরও। ভূমিকম্পের ফলে ঘাতক চোরামাটি হয়ে ওঠে বালি-কাঁকড়ে ভরা পলিমাটি। জলখাত তখন গ্রাস করে নিতে পারে জনপদ। যার সাম্প্রতিক নিদর্শন মেট্রোর কাজ চলাকালীন বৌবাজারের বাড়ি-বিপর্যয়। (ছবি: আর্কাইভ) (ঋণস্বীকার: ১. কলিকাতার রাজপথ সমাজে ও সংস্কৃতিতে: অজিতকুমার বসু, ২. কলিকাতা দর্পণ: রাধারমণ মিত্র,৩. এ হিস্ট্রি অব ক্যালকাটাজ স্ট্রিটস: পি থঙ্কপ্পন নায়ার, ৪. টেন ওয়াকস ইন ক্যালকাটা: প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, ৫. এ জে ওয়াকার্স গাইড টু ক্যালকাটা: সৌমিত্র দাস)