যে সব বাঙালি নাম দেশ-বিদেশে এক কথায় পরিচিত, তার অন্যতম সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
আর যা-ই হোক, যোগী গেঁয়ো নন। তা সত্ত্বেও ভিক্ষা পান না। আলিয়া ভট্ট থেকে দীপিকা পাড়ুকোন, অনুষ্কা শর্মা থেকে ক্যাটরিনা কইফ— সকলেই তাঁর তৈরি পোশাক পরেন। যে সব বাঙালি নাম দেশ-বিদেশে এক কথায় পরিচিত, তার অন্যতম তিনি।
ভারত জয় করার পর হুগলির এই বাঙালি ছেলে এগিয়েছেন বিশ্বজয় করতে। মুম্বই তো কবেই আপন করে নিয়েছে সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়কে। ছবিতে নায়ক-নায়িকার সাজ থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিয়ের আসর, এই ব্রাহ্মণপুত্রের পোশাক ছাড়া ‘সম্পন্ন’ হয় না। কে হবেন সব্যসাচীর এ মরসুমের মুখ, তা নিয়েও বেশ রেষারেষি রয়েছে মুম্বইয়ের তারকাদের মধ্যে। কারণ, মুম্বই বিশ্বাস করে, সব্যসাচী মানেই অন্য রকম কিছু একটা হবে। ওঁর নকশা করা পোশাক পরলে ছবি বেরোবে বিদেশি পত্রিকায়। জগৎ দেখবে। কিন্তু নিজের শহরে দেখা যায় কি তাঁকে? সব্যসাচীর প্রথম বিপণি এ শহরে হলেও পার্টি, বিয়েবাড়ি, এমনকি বাংলা ছবিতে তাঁর দেখা মেলা ভার।
প্রতি বছর নিউ ইয়র্ক শহরে দু’বার করে নিজের সে বছরের কাজ দেখাতে যান হুগলির পুত্র। যে সে জায়গায় নয়। সোজা কুলীনের মধ্যেও কুলীন ‘বার্গডর্ফ গুডম্যান’-এর শোরুমে গিয়ে ঢোকে বাঙালি ছেলের তৈরি শিল্প। ১৯ শতকে চালু হওয়া এই ঐতিহাসিক দোকানে সব্যসাচীর নকশা করা সামগ্রী কিনতে আসেন ম্যানহ্যাটন নিবাসী নানা ক্ষেত্রের সব তারকা।
বিয়েতে দীপিকা-আলিয়া সেজেছিলেন সব্যসাচীর সাজে। ছবি: সংগৃহীত।
আর তাঁর নিজের শহর কলকাতা? চেনে তো বটেই। চেনায় না তবু।
কলকাতায়ও দাপুটে নায়িকা কম নেই। সাজগোজও পছন্দ করেন তাঁরা। কিন্তু সব্যসাচী কোথায়? ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত থেকে কোয়েল মল্লিক, মিমি চক্রবর্তী থেকে নুসরত জাহান— কাউকে তো দেখা যায় না এই তারকা পোশাকশিল্পীর নকশা করা সাজে! মুম্বইয়ে বিয়েবাড়ি গেলেই সব্যসাচীর বস্ত্র-গয়নার ছড়াছড়ি। দক্ষিণ কলকাতায় রয়েছে তাঁর বহু পুরনো বিপণি। তবু টলিপাড়ায় কেন নেই সব্যসাচীর প্রভাব?
প্রশ্ন পড়তেই টলিপাড়ায় হাসাহাসি। এত টাকা কোথায়! বক্তব্য এক প্রবীণ স্টাইলিস্টের। সব্যসাচীর তৈরি পোশাকের যা দাম, তা দিয়ে একটি বাংলা ছবির পুরো খরচই উঠে যেতে পারে। একটি দৃশ্যে নায়ক-নায়িকাকে সাজাতে অত টাকা খরচ করার সামর্থ নেই এখনও বাংলা সিনেমার। দাবি সেই স্টাইলিস্টের। সব্যসাচীর লেহঙ্গা শুরুই হয় ৪ লক্ষ টাকা থেকে। তার পর তো উপরে উঠতেই থাকে। ১০-১৫ লক্ষ টাকার লেহঙ্গাই বেশি। এক পোশাকশিল্পীর প্রশ্ন, ‘‘সেই টাকা বাংলা ছবির কত কী হয়ে যায় বলুন তো? একটি দৃশ্যের জন্য অত দামি লেহঙ্গা কে কিনবে?’’ তাঁর বক্তব্য, বাংলা ছবিতে যদি জমকালো পোশাক পরানোও হয়, তা দিব্যি পাওয়া যায় হাজার চল্লিশের মধ্যে।
ছবিতে নায়ক-নায়িকার সাজ থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিয়ের আসর, এই ব্রাহ্মণপুত্রের পোশাক ছাড়া ‘সম্পন্ন’ হয় না। ছবি: ইমার্গ।
দীপিকা-আলিয়াদের দেখে নিজেদের বিয়ের সাজে সব্যসাচীর নকশা করা লেহঙ্গা-শাড়ি রাখেন অন্য দেশে বসবাস করা ভারতীয় মধ্যবিত্ত পরিবারের রমণীরাও। তেমনও তো দেখা যায় না কলকাতায়? একে কি শুধুই অর্থের অভাব বলে উপেক্ষা করা যায়?
সকলে কিন্তু একমত নন। টলিপাড়ার রূপটান শিল্পী অনিরুদ্ধ চাকলাদারের কাছে বিষয়টির অন্য ব্যাখ্যা রয়েছে। বহু বছর ধরে বিভিন্ন নামী প্রযোজনা সংস্থার তৈরি বাংলা ছবির লুক ডিজাইন করেন তিনি। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যক্তিগত শ্যুট হোক বা বিয়ে, সেখানেও থাকে অনিরুদ্ধের পরামর্শ। সব্যসাচীহীন টলিউডের কথা ওঠায় অনিরুদ্ধ কিন্তু অর্থের প্রসঙ্গ আনেন না। বলেন, ‘‘বাঙালিদের মধ্যে এখনও ডিজাইনার পোশাক পরার প্রবণতা কম। শুধু সব্যসাচীর পোশাক-গয়না পরেন না, এমন কিন্তু নয়। মণীশ মলহোত্র কিংবা তরুণ তহিলিয়ানির পোশাকও কিনতে দেখা যায় না কলকাতার বাঙালিদের।’’ অর্থাৎ, বাঙালিরা এখনও মুম্বইয়ের জাঁকজমক থেকে খানিক দূরে। মূলস্রোতের ফ্যাশনে যেন তেমন মন নেই।
ফ্যাশন তো রূপক মাত্র। অন্যত্রও যে এমনই আচরণ বাঙালির। বাইরের জগৎ সম্পর্কে কতই বা উৎসাহ দেখা যায় কলকাতায়? বাণিজ্য থেকে শিল্প, কোনও ক্ষেত্রেই কি তেমন প্রভাব রয়েছে?
ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে যে এ সব নিয়ে কথা হয় না, এমন নয়। কেউ কেউ দেখেছেন, কলকাতায় একমাত্র এক প্রযোজকের স্ত্রী মাঝেমধ্যে সব্যসাচীর নকশা করা শাড়ি পরেন। সম্প্রতি বিয়েবাড়ি গিয়ে আর এক জনকে দেখা গিয়েছে সব্যসাচীর গয়নায়। তিনিও আর এক প্রযোজকের স্ত্রী। তবে ওই এক-আধ জন। তাই এক বার দেখলে সকলের মনে থাকে কে কবে ‘সব্যসাচী’ পরেছিলেন। কলকাতা এখনও এ ভাবেই চলছে।
সব্যসাচীর মতো সাজ বাংলায় এখনও তেমন প্রচলিত নয়। এ কথাই বলে থাকেন কেউ কেউ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্টাইলিস্টের ব্যাখ্যা, কেউ এক বার সব্যসাচীর কোনও একটি শাড়ি বা গয়না কিনতে হয়তো পারেন। কিন্তু তা দিয়ে কি চলবে নাকি! বার বার তো এক পোশাক পরে বিভিন্ন জায়গায় দেখা দেবেন না অভিনেত্রীরা। নামী শিল্পীদের তৈরি পোশাক ভাড়া নিয়ে পরতেও অনেক খরচ হয়। সে খরচ করার অভ্যাসও কলকাতায় তেমন তৈরি হয়নি। বাঙালিরা এখনও কয়েক প্রজন্ম ধরে এক শাড়ি পরায় বিশ্বাসী। তাই ডিজাইনার পোশাকের চেয়ে বেশি টান স্থানীয় সাবেক সাজের ধারায়।
কারণ পরে আসুক। একটি কথা তবে স্পষ্ট। বাঙালি বাংলায় তুষ্ট। সাজেও বিশেষ বেড়া ভাঙার ইচ্ছা রাখে না। তাই তো?
সঞ্চিতা পাল চক্রবর্তী বহু জনপ্রিয় বাংলা ছবিতে স্টাইলিং করেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ বলছে, বাংলা ছবিতে এখনও সে ধরনের কাজই হয় না, যাতে সব্যসাচীর মতো কোনও বড় পোশাকশিল্পীর নকশা করা জামাকাপড় ব্যবহার করা জরুরি হবে। তাই বলে ফ্যাশন নিয়ে নাড়াচাড়া হয় না, এ কথা মানেন না সঞ্চিতা। তিনি বলেন, ‘‘অনেকে মনে করেন বাংলা ছবিতে ডিজাইনার পোশাক দেখা যায় না। তা কিন্তু ঠিক নয়। শুধু ছবি কেন, ধারাবাহিকেও ডিজাইনারদের তৈরি পোশাক ব্যবহার করা হয়। তবে এখানে যে সব নকশা বেশি চলে, শহরের পোশাকশিল্পীরাও তেমন কাজই করেন।’’ এক সময়ে যেমন গোটা শহরে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল বাহা শাড়ি। সে তো একটি ধারাবাহিকের অনুপ্ররণাই। সঞ্চিতা জানান, এখন আবার জামদানির উপর অনেক ধরনের কাজ হচ্ছে। সে সব যেমন ছবিতে ব্যবহৃত হচ্ছে, তেমন বহু অনুষ্ঠানেও পরতে দেখা যাচ্ছে সে ধরনের পোশাক। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পোশাকশিল্পীদের তৈরি সে ধরনের জামাকাপড় ভাড়া নিয়ে বহু ছবির প্রিমিয়ার কিংবা পুজোর উদ্বোধনে যান। তবে দামে তা সব্যসাচীর পোশাকের ধারেকাছে নয়।
নিউ ইয়র্কে সব্যসাচীর বিপণি। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।
অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও বহু নতুন পোশাকশিল্পীর নকশা করা শাড়ি-জামা পরেন। কোনও এক জনের তৈরি পোশাক পরেই দিনের পর দিন কাটাবেন না নায়িকা। তাঁর সাজে নতুনত্ব আসুক, সেটাই পছন্দের। তিনি বলেন, ‘‘নতুন ডিজাইনারদের কাজ সকলের সামনে তুলে ধরতে আমার ভাল লাগে। এখন আমাদের শহরে কত ধরনের কাজ হচ্ছে, সে সব পরতে আমার ভাল লাগে। এ সময়ে যাঁরা কলকাতায় কাজ করছেন, তাঁদের পোশাক পরতে আমার ভালই লাগে।’’
ইন্ডাস্ট্রির সাজপোশাকের রুচি নিয়ে কথা বলতে সহজ নন অনেকেই। কেউ বলেন, অর্থের অভাব। কেউ আবার বিষয়টিকে দেখেন আঞ্চলিক গর্বের দিক থেকে। ঋতুপর্ণা কয়েকটি দিক ভেবে দেখতে বলছেন। এক সময়ে তাঁর একটি ছবিতে পোশাকের নকশা করেছিলেন ‘পেপসি’ (সব্যসাচীকে সে নামেই ডাকেন তাঁর সহকর্মীরা)। তবে সে অনেক কাল আগের কথা। সব্যসাচী তখনও বিখ্যাত নন মুম্বইয়ে। সে সময়ে ঋতুপর্ণার কিছু ফোটোশুটেও সব্যসাচীর পোশাক ব্যবহার করা হয়। অভিনেত্রীর নিজের আলমারিতে রয়েছে বিখ্যাত এই পোশাকশিল্পীর নকশা করা জ্যাকেট। কিন্তু ঋতুপর্ণার মত, ‘‘সব্যসাচীও হয়তো কলকাতার চেয়ে মুম্বইয়ে মন দিয়েছেন বেশি। তিনিও এখানকার কাজ বিশেষ করেন না। তাই তাঁর কাজ কলকাতায় খুব একটা দেখাও যায় না।’’ না দেখা গেলে আর জনপ্রিয় হবে কোথা থেকে, প্রশ্ন রয়েছে নায়িকার মনে।
মুম্বই তো কবেই আপন করে নিয়েছে সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়কে। ছবি: ইমার্গ।
দক্ষিণ কলকাতার ল্যান্সডাউনে আগের মতো এখনও আছে সব্যসাচীর বিপণি। চাইলে গিয়ে দেখাই যায় সেখানে। তবে স্টাইলিস্ট থেকে ডিজাইনার, বিভিন্ন জনের বক্তব্য একই। সব্যসাচীর শাড়ি যত না পরতে চান কলকাতার সুন্দরীরা, তার চেয়ে বেশি আঞ্চলিক সাজগোজই পছন্দ তাঁদের। সঞ্চিতা যেমন বলছিলেন, ‘‘সুতির কাপড়ের উপর অনেক ধরনের কাজ হচ্ছে এখানে। নতুন বহু পোশাকশিল্পী সে ধরনের কাজ করছেন। তেমন পোশাক পরার চলও তৈরি হয়েছে।’’ ঋতুপর্ণা আবার মনে করেন, সব্যসাচীর তৈরি পোশাক খুব সুন্দর হলেও তা হয়তো বাঙালি রুচির সঙ্গে সব সময়ে মেলে না। মুম্বইয়ে যেমন লেহঙ্গা, চোলি, জমকালো গয়না পরার চল তৈরি হয়েছে, তা এখনও এখানে হয়নি। আর সব্যসাচীর তৈরি পোশাক অনেক ক্ষেত্রেই তেমন।
আরও একটি বিষয় নিয়ে চলে আলোচনা, যা মিলে যায় ঋতুপর্ণার বক্তব্যের ধাঁচের সঙ্গে। নামী পোশাকশিল্পীদের নকশা করা জিনিসপত্রে যে জাঁকজমক থাকে, তা নাকি এখনও কলকাতার ফ্যাশনে আসেনি! তার মানে কি ধরে নিতে হয় যে, কলকাতা এখনও সাজের বিষয়ে খানিক আঞ্চলিক?
সব্যসাচী এককালে কলকাতাতেও কাজ করেছেন। অনেকেরই পরিচিত। তাঁর কাজও পছন্দ বহু জনের। কিন্তু কোথায় যেন অভিমানের সুর রয়েছে সব্যসাচীকে নিয়ে। সব্যসাচী নিজে কলকাতার তারকাদের নিয়ে কাজ করার বিশেষ আগ্রহ দেখান না, সে সংক্রান্ত অভিমান রয়েছে টলিপাড়ার অলিগলিতে। ঋতুপর্ণা অবশ্য বলেন, ‘‘সকলের নিজের পছন্দ থাকে। পেপসিও হয়তো নিজেকে মুম্বইতে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। বড় জায়গায় কাজ দেখানোর ইচ্ছা কার না হয়!’’
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়। সব্যসাচীর পোশাক পরার ইচ্ছা থাকলে কি আর তাঁর যোগাযোগ করার অপেক্ষায় থাকত কলকাতা? না কি আঞ্চলিকতা ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক হতে পারেনি এখনও এ শহর? তাই কি এখনও আটপৌরে নকশায় আটকে এ শহর? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, কলকাতার এক জনপ্রিয় পোশাকশিল্পী এ ভাবনার সঙ্গে একমত। বলেন, ‘‘তসর-গরদ-জামদানির বাইরে বেরোলে বাংলায় কোনও পোশাকই প্রায় চলে না। ফলে নিজের শিল্পসত্তাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।’’ আর সে সব ভাবনাকে তোয়াক্কা না করেই কল্লোলিনী মাতে নিজের সাজে।