লখনউ দেখার সময় ইমামবড়া-ভুলভুলাইয়া তো দেখবেনই। সকলেই দেখে। আসুন, তার আগে ঘুরে আসি ‘রেসিডেন্সি’। শহরের এক প্রান্তে ইতিহাসের এই আকরে পর্যটকদের পা প্রায় পড়ে না বললেই চলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেও এই নামে হোঁচট খান। আপনি একটা অ্যাপ ক্যাব নিতে পারেন। চালকের পক্ষে ‘রেসিডেন্সি’ কিছুটা দুর্বোধ্য লাগলেও গুগল ম্যাপ আপনাকে ঠিক পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। যেতে পারেন মেট্রো রেলেও।
বিস্তৃত প্রান্তরের উপর খুব সুন্দর করে সংরক্ষিত হয়ে আছে বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই ‘রেসিডেন্সি’। যার নির্মাণপর্ব শুরু হয়েছিল নবাব আসফ-উদ-দৌলার আমলে। শেষ হয় নবাব দ্বিতীয় সাদাত আলি খানের সময়। ১৭৮০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এর নির্মাণকাজ চলেছিল।
পরে নবাবদের নির্মাণের মালিকানা চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। ৩৩ একর জমির উপর নির্মাণ হয়ে ওঠে সেনাদের জন্য নির্ধারিত এলাকা ‘রেসিডেন্সি’। ব্রিটিশ আভিজাত্য ও গৌরবের এই প্রতীক সিপাই বিদ্রোহের আগুনে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল। গাছগাছালি আর সবুজ ঘাসের মধ্যে পোড়া বাড়ির ভগ্নস্তূপগুলির সামনে দাঁড়ালে খোদ ইতিহাসেরই ছায়ায় যেন প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই থেকে ১৭ নভেম্বর বিদ্রোহী সেনাদের আগ্নেয়াস্ত্রর সামনে অবরুদ্ধ ছিল গোটা রেসিডেন্সি।
কে একে ঘুরে দেখুন মূল ভবন, ব্যাঙ্কোয়েট হল এবং ট্রেজারি। এছাড়াও আছে গাবিনস হাউস, ডক্টর ফেয়েরারস হাউস এবং অ্যান্ডারসনস পোস্ট। এক এক জন সেনা আধিকারিকের নামে নামকরণ করা হয়েছিল তাঁদের ভবনের। এই ভবনগুলির নির্মাণশৈলিতে ব্রিটিশ ঘরানার আধিপত্য স্পষ্ট। একটিমাত্র ভবন নির্মিত হয়েছিল সম্পূর্ণ ইসলামিক শৈলিতে। সেটি হল ‘বেগম কোঠি’। এই জেনানা মহল বহু বার হাতবদল হয়েছে। নবাবি আমলের বিলাসব্যসনের প্রতীক ছিল এই চত্বরের ‘ব্যাঙ্কোয়েট হল’। বহুমূল্য ঝাড়বাতি, আসবাবপত্র, আয়না এবং রেশমি পর্দায় সাজানো এই ভবনে নবাবদের সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করা হত। আমোদপ্রমোদের এই ভবনই পরবর্তীতে সিপাই বিদ্রোহের সময় রূপান্তরিত হয়েছিল জরুরিকালীন হাসপাতালে।
‘রেসিডেন্সি’ এক দিকে সৈন্যদের বীরত্বের প্রতীক। অন্যদিকে, ব্রিটিশরা একে নিজেরে শৌর্য স্মারক বলে মনে করে। বহু রক্তক্ষয়ের পরে ‘রেসিডেন্সি’ ফিরে পেয়েছিল রাজশক্তি। কাছেই একটি সমাধিক্ষেত্রে স্যর হেনরি লরেন্স-সহ ২০০০ জনের শেষশয্যা আছে। রেসিডেন্সিতে বিদ্রোহীদের অবরোধ বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ করেছিলেন লরেন্স। কিন্তু শেষ অবধি প্রাণ হারিয়েছিলেন। ব্রিটিশরা প্রবলভাবে সিপাই বিদ্রোহ দমন করেছিল। কিন্তু বহু ঐতিহাসিকের মতে, নিছক সিপাইদের প্রতিবাদ নয়। এই অগ্ন্যুৎপাত ছিল স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রাক মুহূর্ত।
সিপাই বিদ্রোহের স্মারক সৌধের পরে দেখতেই হবে ফেলুদার আংটি লুকিয়ে রাখার বিখ্যাত ‘ভুলভুলাইয়া’। এই অংশটার জন্য বাকি স্থাপত্যের পরিচয় কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে গিয়েছে। এই নির্মাণ আদতে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র ‘ইমমাবড়া’। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রবল দুর্ভিক্ষের সময় কর্মসংস্থানের জন্য নবাব আসফ উদ দৌলা এই ইমামবড়া তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। এখানেই আছে তাঁর অনাড়ম্বর সমাধি।
এই ইমামবড়ার উপরের অংশই হল ‘ভুলভুলাইয়া’। কেন এই বিশেষ নির্মাণ? তাঁর নির্দিষ্ট কোনও কারণ জানা যায় না আজও। সবথেকে মুখরোচক তত্ত্ব হল নবাব রাতের অন্ধকারে ভুলভুলাইয়াতে তাঁর বেগমদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন। তখন কুঠুরিগুলিতে জ্বলত ঘিয়ের প্রদীপ। কিন্তু ঐতিহাসিকরা এই তত্ত্বকে গুরুত্ব দেন না। তাঁদের মধ্যে অনেকের মত, স্থাপত্যের কোনও একটি ভুলকে সামলাতে গিয়েই স্থপতিকে তৈরি করতে হয়েছিল আস্ত ভুলভুলাইয়া। আবার অনেকে মনে করেন, ইমামবড়ায় স্থাপত্যের নির্মাণের ভারসাম্য রক্ষা এবং এর মধ্যে বছরভর প্রকৃতির সঙ্গে অনুকূল আবহাওয়া তৈরিই ছিল ভুলভুলাইয়ার উদ্দেশ্য। গাইডের সঙ্গে ভুলভুলাইয়া ঘুরে পা রাখুন ইমামবড়া-র ছাদে। চারদিকে তাকালে হাইরাইজের উঁকিঝুকি সত্ত্বেও মন চলে যেতে বাধ্য নবাবি আমলে। আবার ছাদ থেকে ইমামবড়ার চত্বরে নামতে হবে ভুলভুলাইয়া পেরিয়েই।
বড়া ইমামবড়া চত্বরেই আছে ‘শাহি বাওলি’ বা রাজকীয় ধাপকুয়ো। গরমে জলকষ্ট দূর করতে জলের সংস্থানের সৌন্দর্যও যে কত রাজকীয় হতে পারে, এই নবাবি নির্মাণ না দেখলে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। তবে ভুলভুলাইয়া এবং ‘শাহি বাওলি’-র দেওয়ালে খোদাই করা ‘অমুক প্লাস তমুকের’ নামের আদ্যক্ষর এবং তিরবিদ্ধ হৃদয় চক্ষুপীড়ার পক্ষে যথেষ্ট।
বড়া ইমামবড়া যাওয়া আসার পথেই আপনি দেখতে পাবেন ‘রুমি দরওয়াজা’, নবাবি অওয়ধের প্রবেশদ্বার। হাতে সময় থাকলে ঘুরে ঘুরে দেখে নিন ছোটা ইমামবড়া, আমিনাবাদ, কায়জরবাগ, আলমবাগ, অল সেন্টস গ্যারিসন চার্চ, বেগম হজরত মহল পার্ক এবং কবি মীর বাবর আলি আনিসের সমাধি।
ইতিহাসের পাশাপাশি কিছুটা সময় রাখুন গলহৌটি কাবাব আর চিকনকারির জন্যও। কলকাতার বিরিয়ানির স্বাদ যারা পেয়েছেন, তাঁদের কাছে লখনউয়ের বিরিয়ানি সুমধুর নাও লাগতে পারে। তবে কাবাবের খেতে ভুলবেন না। লখনউ ছেড়ে কলকাতা চলে আসার সময় ওয়াজিদ আলি শাহের মতো কার্যত সম্পূর্ণ অওয়ধকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারবেন না ঠিকই। তবে প্রিয়জনের জন্য নিতেই পারেন মিঠে রঙের কাপড়ে চিকনসৌন্দর্য।
কলকাতা থেকে কীভাবে যাবেন ঃ
অকাল তখত্, জম্মু তাওয়াই, কুম্ভ এক্সপ্রেস, হামসফর এক্সপ্রেস, অমৃতসর এক্সপ্রেস, অমৃতসর মেল, দুন এক্সপ্রেস, বাগ এক্সপ্রেস, হিমগিরি এক্সপ্রেস-সহ একাধিক ট্রেনে আপনাকে পৌঁছে দেবে লখনউ। আকাশপথে যেতে চাইলে কলকাতা থেকে লখনউ বিমানবন্দরগামী বিভিন্ন উড়ান পেয়ে যাবেন।