Follow us on

Download the latest Anandabazar app

© 2021 ABP Pvt. Ltd.

Advertisement

২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ই-পেপার

লকডাউনে যখন রান্নাঘরই বাঙালির মাস্টারমশাই

মানসিক ভাবে সুস্থ থাকার জন্যে সবাইকে চাঙ্গা রাখতে রান্নাঘরটা যে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে, এটা কি কেউ জানত?

পিণাকী ভট্টাচার্য
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১২:৪৪

ডালগোনা কফি

আগের বছর মার্চ মাসের শেষের দিকে যখন হঠাৎ পৃথিবীটা থমকে দাঁড়িয়ে গেল, প্রথম কয়েকটা দিন বেশ এক অন্য রকম ছুটি মনে ভেবে উল্লসিত হয়েছিলাম। বাড়িতে থাকতে হবে, কেউ বেরতে পারবে না, বাজার অবধি করতে যেতে হবে না। কিন্তু ক’দিন বাদেই স্ফূর্তির বেলুন ফুসসস করে চুপসে গেল একটা প্রশ্নে ধাক্কা খেয়ে— খাব কী? কী খাব? কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কারের মতো শ্রম বিভাজন করতে পারলেও রান্নাটা গিন্নিকেই করতে হয়, আর সেই রান্না যত্ন নিয়ে করলেও মেয়েরা ডিমের কষা মুখ কুঁচকে খায়, যেন কালমেঘ পাতা খাচ্ছে। ও দিকে গিন্নির মেজাজের তাপে লুচি ভাজা হয়ে যাবে।

এটা আমার গল্প নয়। আমাদের সব্বার গল্প। এই অতিমারি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। সময়, পরিবেশ, পরিবার, বন্ধু, স্বজন, সুস্বাস্থ্য সব কিছু আমাদের নতুন করে শেখাল বেঁচে থাকা আর ভাল থাকার চেয়ে বড় কিচ্ছু হয় না। এক থমকে থাকা পৃথিবীতে যখন রাশি রাশি দুশ্চিন্তা ধেয়ে আসে আর আগামিকালটা অস্পষ্ট হতে হতে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন মানসিক ভাবে সুস্থ থাকার জন্যে সবাইকে চাঙ্গা রাখতে রান্নাঘরটা যে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে, এটা কি কেউ জানত? শুভ্র ব্যবসায়ী মানুষ, বছরের নির্দিষ্ট কয়েক মাস ওর জন্যে খুব গুরুত্বের। লকডাউন পিরিয়ডে হতাশা আর ভয় থেকে দূরে থাকতে রান্নাঘরে ঢুকেছিলও। মেয়েদের মুখে হাসিটা ধরে রাখতে সে বাড়িতে ফুচকা, বোঁদে, মোমো সব কিছু বানিয়েছে। আর বানাতে গিয়ে দেখেছে, এগুলো রান্নাঘরের রোজকার বাসন দিয়েই বানানো যায়। সে আটা আর সুজি মিশিয়ে রুটির মতো বেলে চাটনি খাওয়ার ছোট বাটি দিয়ে গোল করে কেটেছে আর ছাঁকা তেলে ভেজে ফুচকা বানিয়েছে। মোমো বানানোর জন্যে ভেবেচিন্তে প্রেশার কুকারের স্ট্যান্ড ব্যবহার করেছে যার ছিদ্রগুলো দিয়ে অনায়াসে বাষ্প যেতে পারে। বোঁদে বানিয়েছে লুচি ভাজার ছান্তা দিয়ে বেসন গোলা তেলে ফেলে। এই সব বানিয়ে শুভ্র পেয়েছে তার মেয়েদের অনাবিল আনন্দ আর বিশ্বাস, ও পেয়েছে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর জোর।

Advertisement

মা, বাবা, ভাই, পিসি, ঠাম্মা, দিম্মা নিয়ে ক্লাস সেভেনের মিঠাইয়ের সংসার। সকালটা সে ইস্কুলের, সন্ধের পর থেকে বাড়ির লোকের, দুপুরটা ছিল তার নিজের। হঠাৎ একদিন সে দেখল পৃথিবীটা অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। বাবা আর পিসি বাড়িতে থেকে অফিস করে, বাইরে নাকি অসুখ। তাই বেরনো বারণ। এদিকে মা’কে রোজ বেরতে হচ্ছে অফিসে। বাড়িতে সব সময় একটা অসুখের ভয়ে দিনরাত থাকতে থাকতে একদিন সে লেবুর রস, ইনো আর হজমোলা গুঁড়ো করে তাতে দিয়ে শিকঞ্জি বানাতে শিখে গিয়েছে। এর সঙ্গে শিখেছে ডালগোনা কফি আর ক্রেপ বানাতে। ছোট্ট মিঠাইয়ের কফি আর চিনি মেশানো দেখে বাড়ির বড়রা হেসে ফেলে আর চিন্তাকে দূরে ছড়ে ফেলে খানিকক্ষণের জন্যে অন্তত। আর এই হাসিমুখটা বার বার ফেরত পেতে চায়, তাই বার বার রান্নাঘরে দৌড়য় পড়ার ফাঁকে। শিকঞ্জি করার সময় ঠাম্মার সরবতে চিনি না দিয়ে সুগার্-ফ্রি গুঁড়ো করে দেয় তিনি সুগারের রোগী বলে। কোভিড মিঠাইকে যত্ন শিখিয়েছে। ওকেও শিখিয়েছে, বাড়ির লোকের মুখের হাসি আর আনন্দের চেয়ে দামি কিছু হয় না।

শুভ্র আর মিঠাইয়ের একই গৃহশিক্ষক। রান্নাঘর। ডালগোনা কফি হোক বা ফুচকা, মোমো, ক্রেপ— সোশাল মিডিয়ায় ভরে ওঠা রান্নার ছবি, ভাইরাল হওয়া পদ সবই যেন মুখের এক চিলতে হাসির জন্য। রান্নার সঙ্গে আবেগের এক অবিচ্ছেদ্য সখ্য দেখাল লকডাউন।

Advertisement