এ রকম হয় না, কাউকে ভালবাসি, কিন্তু কেন ভালবাসি জানি না! কলকাতার সঙ্গে আমার সম্পর্কও ঠিক সে রকম। এই শহরটাকে খুব ভালবাসি। কিন্তু এই অনুভূতির পিছনে কারণটা ঠিক জানি না। এই প্রেমটা টের পাই, যখন বাইরে যাই। সেটা বেড়াতে গেলেও হয়। আবার, কোনও কাজের সূত্রেও গেলেও এমন মনে হয়। কিছু দিন পর থেকেই মনখারাপ শুরু হয়ে যায়। মনে হয় কবে নিজের শহরে ফিরব। আমি খুব আড্ডাবাজ নই। কলকাতায় যে ইদানীং বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে প্রচুর দেখাসাক্ষাৎ হয়, তা-ও নয়। আসলে, এই শহরটা আমার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। কলকাতার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। পৃথিবীর প্রতি শহরের ভাল এবং খারাপ দিক আছে। হতেই পারে অনেক শহর কলকাতার থেকে বহু গুণ বেশি পরিষ্কার। তারা হয়তো সৌন্দর্যের দিক থেকেও বেশ কিছুটা এগিয়ে। কিন্তু সেই বস্তুতান্ত্রিক সরবরাহ তো সব সময় শেষ কথা বলে না। মনের স্বাচ্ছন্দ্যও তো একটা মাপকাঠি। সেই মানসিক স্থিতি বা সুখ আমি খুঁজে পাই কলকাতাতেই। এই শহর ছাড়া অন্য কোথাও থাকার কথা ভাবতেই পারি না। কয়েক দিনের জন্য বেড়ানো বা শ্যুটিং-এর সূত্রে হয়তো যেতেই পারি। কিন্তু পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য কলকাতা বিকল্পহীন।
একটা কথা খুব মনে হয়। খাওয়াদাওয়া, থাকা —জীবনের সব ধাপেই এই শহরটা দু’হাত বাড়িয়ে আন্তরিকতার ডালি সাজিয়ে অপেক্ষা করে আছে, সকলের জন্য। কলকাতার এই সর্বজনীন দিকটা বোঝা যায় সব চেয়ে বেশি খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে। এখানে যেমন পাইস হোটেলে পেটপুরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা যায়। আবার পাঁচতারা হোটেলে বসে বিলাসিতায় গা ভাসানো যায়। যার যেমন সাধ্য, সেই অনুযায়ী ভোজনবিলাসের সকল আয়োজন হাজির।
কলকাতাকে ভালবাসি, কিন্তু কেন জানি না, তাই এই শহর থেকে আলাদা হওয়ার কথা ভাবতে পারি না
এই শহরটা আমার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। কলকাতার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা ভাবতেই পারি না।
অভিনেতা: রজতাভ দত্ত
এই শহরের প্রতিটা অংশের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। উত্তরকে আপনি দক্ষিণে পাবেন না। দক্ষিণ গরহাজির উত্তরে। আবার সল্টলেক যেন সকলের থেকে একেবারে আলাদা। আমার শৈশব কেটেছে দক্ষিণ কলকাতায়। ১৯৯০ সাল অবধি থাকতাম সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে। পড়তাম বালিগঞ্জ গর্ভনমেন্ট স্কুলে। তার পর গোয়েঙ্কা কলেজ। দক্ষিণ থেকে সোজা উত্তর কলকাতা। ১৯৯১ থেকে আমি সল্টলেকের বাসিন্দা। এখানে এসে প্রথম প্রথম আমি খুব দক্ষিণ কলকাতাকে মিস করতাম। এখন আবার সল্টলেককে ভালবেসে ফেলেছি। এখানে চকচকে পরিবেশটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং,পুজোর সময় আমি বেশ মফস্সলের আমেজ পাই। প্রত্যেক ব্লকের পুজোয় একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করা, আনন্দে যোগ দেওয়া থেকে পুজো ঘিরে পাড়ার জলসা—এই সব কিছুর মধ্যে আমি সাবেক পাড়া সংস্কৃতি খুঁজে পাই। একটা পারিবারিক আন্তরিকতা ঘিরে থাকে। সল্টলেক উপনগরী মানেই আমার পরিণত বয়সের স্মৃতি। সে দিক দিয়ে দক্ষিণ কলকাতা আমার উড়তে শেখার জায়গা। কত যে বাঁদরামোর অভিজ্ঞতা সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে! অবশ্য বলতে গেলে, সারা কলকাতা জুড়েই ছড়িয়ে আছে রোমাঞ্চকর উপাদান।
কলকাতায় বড় হওয়া মানেই বইমেলা এবং চলচ্চিত্র উৎসবের স্মৃতি। এখন আর যেতে
পারি না ঠিকই। কিন্তু আমার মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের শিকড় ছড়িয়ে আছে শীতের
কলকাতার এই দু’টি পার্বণে। আর কলকাতা জড়িয়ে আছে আমার প্রেম, থিয়েটার
থেকে পুরো জীবনের সঙ্গে। আমার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে।