কলকাতাকে ভালবাসার অন্যতম কারণ হল এর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। নাটকের এই আবহ অন্য আর কোথায় পাব! আমার কলকাতা মানে কবীর সুমনের গান, জয় গোস্বামীর কবিতা, নান্দীকারের নাটক, পিট সিগারের গান, ডোভার লেন এবং কফি হাউসের আড্ডা। মাঝে মাঝে মেটিয়াবুরুজে কাওয়ালির আসরেও শ্রোতা হিসেবে হাজির থেকেছি। আমি যখন নাটক দেখা উপভোগ করতে শিখেছি, তখন উত্তর কলকাতার থিয়েটারপাড়া কার্যত ক্ষয়িষ্ণু। সেই নিভু নিভু চুল্লির আগুনেই দেখেছি ‘নীলকণ্ঠ’, ‘ফেরা’, এবং ‘ঘটকবিদায়’-এর মতো নাটক। সাহিত্যের মতো কলকাতারও কিন্তু বেশ কিছু প্লট এবং সাবপ্লট আছে। আমার কাছে
বাকি সব ছাপিয়ে কলকাতার থিয়েটার-সহ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলই মুখ্য। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা প্রেক্ষিতে এই শহরকে দেখে। ফলে নতুন নতুন বিশেষণে
সাজিয়ে তোলে এই প্রাণবন্ত শহরকে। যেমন শহরের সমান্তরাল একটি গোষ্ঠীর কাছে খালাসিটোলা ছিল প্রায় তীর্থক্ষেত্র। সে দিক দিয়ে আমার প্রিয় গন্তব্য ‘অলি
পাব’ এবং ‘ম্যাজেস্টিক’। আর বিরিয়ানি এবং মোগলাই খাবার? সেখানে কলকাতা বিশ্বের সব শহরকে টেক্কা দেবে। অন্তত আমার তো সেটাই মনে হয়। বিরিয়ানি-সহ সবরকম মোগলাই খাবার আমার খুব প্রিয়। কলকাতার কোথায় মোগলাই খাইনি আমি! পাঁচতারা হোটেল থেকে ফুটপাতের ঝুপড়ি হোটেল, কিচ্ছু বাদ দিইনি।
এ ছাড়া আমার ভাল লাগে নিখাদ বাঙালি খাবার। তার জন্য আমার প্রিয় গন্তব্য ডালহৌসির অফিসপাড়া। এই এলাকার দোকানের খাবার খেয়ে কেউ অসুস্থ হয় না। এর স্বাদ ভাল লাগেনি, সে রকমও সম্ভব নয়। আমার তো ডালহৌসিতে গেলে মনে হয়, যেন খাবারের মেলা বসেছে! আরও একটা জিনিস মনে হয়। তার জন্য অবশ্য বেশ খারাপও লাগে। সেটা হল, কলকাতার একটা বড় অংশে ফুটপাত বলে কিছু নেই। শহরবাসীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে নাগরিকজীবনের ন্যূনতম পরিষেবাও। আবার অন্য দিকে ফুটপাতের মানুষগুলোও নিরুপায়। ফুটপাতই তাদের রুটিরুজি, কোথাও কোথাও ঘরবাড়িও। আমরা তাদের বিকল্প পথ দিতে পারিনি। শহরবাসীকে ফুটপাতও দিতে ব্যর্থ। আরও একটা জিনিসেরও অভাব আছে কলকাতায়। ভাল পার্ক বেশি নেই শহরে। তা হলে প্রেমিক প্রেমিকা কোথায় দু’দণ্ড বসবেন? এই যে পার্কে গিয়ে পুলিশের ধরপাকড় বা মেট্রোরেলে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ানোর জন্য তরুণ তরুণীর হেনস্থা— এই ঘটনাগুলো দেখলে মনে হয় আমরা কোথায় যেন এখনও অনাধুনিক। আরও মুক্তমনা, উদার হতে হবে আমাদের। প্রত্যেক শহরেরই তো একটা নিজস্ব চরিত্র আছে। কলকাতারও আছে। সেই নিজস্বতাটুকু বাদ দিলে বহিরঙ্গে কিন্তু দেশের বড় শহরগুলির সঙ্গে বিশেষ পার্থক্য নেই এখন। যে দিকে তাকাই শুধু আকাশছোঁয়া বহুতল। তার পাশেই বস্তি। এই বৈসাদৃশ্য চোখ এবং মন, দু’য়ের জন্যই পীড়াদায়ক। বাইপাস, তিলজলার মতো এলাকায় এই অসাম্য খুব প্রকট। কলকাতা কিন্তু এ রকম ছিল না। এখানে ধনী এবং দরিদ্র, দু’টি শ্রেণির জন্যই নিজস্ব পরিসর ছিল। কিন্তু এখন দরিদ্ররা খুব কোণঠাসা বলে আমার মনে হয়। উন্নয়ন যত ডানা মেলছে, দরিদ্র মানুষের জন্য সুযোগসুবিধে যেন ততই সঙ্কুচিত হচ্ছে। কেন যেন মনে হয়, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন, জোহানেসবার্গ বা লাতিন আমেরিকার কোনও শহরের ছবি দেখছি। সেখানেও এই অসাম্য বা বৈসাদৃশ্য তীব্র।