কলকাতা আমার কাছে একটি জীবন্ত শহর। অন্যান্য় মেট্রোপলিটন শহরগুলিতে হয়তো কলকাতার চেয়ে সুযোগ-সুবিধা খানিক বেশি। অনেক বেশি ঝা-চকচকে সে সব জায়গা। কিন্তু সেখানে প্রাণের স্পন্দন পাইনি। বড্ড প্রাণহীন মনে হয়েছে। কলকাতায় থাকার যে সুখ, তা অন্য কোথাও পাইনি। নিজের শহর বলে বলছি না, এ আমার একেবারে সত্যিকারের অনুভূতি।
আমার শহর শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্পে, ঐতিহ্যে অনেক এগিয়ে।
আমি তো স্বপ্নেও ভাবতে পারি না যে, কলকাতাকে ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে পাকাপাকি ভাবে থাকব। এই শহরের নিজস্ব কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে। যেগুলি মাঝেমাঝে আমাকে পীড়া দেয় বটে। কিন্তু তা-ও কোনও কিছুর বিনিময়ে শহর ছেড়ে দূরে গিয়ে পুরোপুরি থাকার কথা ভাবতেই আমার দমবন্ধ লাগে।
আমরা সকলেই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ হতে দেখি। কিন্তু এই শহরে নাটকের মাধ্যমে হোক, গানের মধ্যে দিয়ে হোক কিংবা সিনেমা— সর্বোপরি শিল্পকে মাধ্যম করে কিন্তু প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। অন্যান্য জায়গায় যখন শিল্পেরও টুঁটি চিপে ধরা হয়, তখন কলকাতা কিন্তু আড়াল থেকে শক্তি জোগায়। ভরসা দেয়। সাহস দেয়।
আমার কৃত্রিম কোনও সৌন্দর্য একেবারেই ভাল লাগে না। আমার শহরে আকাশ ছোঁয়া বাড়ি, ঝা চকচকে শপিংমল, আধুনিক রেস্তরাঁ— অর্থাৎ, একটি শহর গড়ে উঠতে যা যা লাগে কলকাতায় তার অধিকাংশই আছে। আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, এই সব কিছুর মধ্যেই একটা কৃত্রিম সৌন্দর্যের ছাপ আছে। কিন্তু যখন কাজ সেরে ফেরার পথে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরেটায় চোখ রাখি, আমার শহরের একটা আলগা শ্রী খুঁজে পাই। ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে আছে, অথচ তার মধ্যেও একটা আন্তরিকতা আছে। আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে।
নাটক, সিনেমা, সিরিজে অভিনয় করার সূত্রে প্রচুর মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। রাস্তায় বেরোলে কেউ কেউ চিনতেও পারেন। ফলে এখন আর বাসে, ট্রাম, মেট্রোয় চড়ার সুযোগটা হয়ে ওঠে না। সত্যি বলতে, সেগুলি আমি ‘মিস’ করি। কারণ গাড়ি করে গেলে হয়তো সময়ে এবং আরামে পৌঁছনো যায়, কিন্তু কলকাতাকে চেনার জন্য বাস কিংবা ট্রামের জানলা হল আদর্শ জায়গা।
ওটিটি-র দৌলতে শুধু কলকাতা নয়, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও নিজের কিছুটা পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছি ঠিকই। কিন্তু আমার সব প্রাপ্তি কলকাতার হাত ধরে। আমি আজ যতটুকু যা করতে পারছি, তাতে কলকাতা প্রায় পুরোটাই জড়িয়ে আছি।
আমার অভিনয়ের শুরুটা যেহেতু নাটকের হাত ধরে, ফলে কলকাতার প্রায় প্রত্যেকটি থিয়েটারের হল আমার খুব কাছের। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মিনার্ভা এবং গিরিশ মঞ্চ, এই দু’টি সরকারি হল ছাড়া উত্তর কলকাতার বাকি থিয়েটারের হলগুলির কোনওটিরই আর অস্তিত্ব নেই। হয় সেগুলি ভেঙে সিনেমা হল হয়ে গিয়েছে, নয়তো বড় বড় বাড়ি উঠেছে। সিনেমার সিঙ্গল স্ক্রিনগুলিও যেমন একটা একটা করে শপিং মলে পরিণত হচ্ছে। আমার মাঝেমাঝে মনে হয়, বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্য, আবেগ, ভালবাসা বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোনও পদক্ষেপ করা গেলে ভাল হত। আগামী প্রজন্মও তাহলে এই সংস্কৃতির স্বাদ পেত।
যে দিন প্রথম অ্যাকাডেমির মঞ্চে অভিনয় করলাম, সেই দিনটির কথা আমার আজও মনে আছে। তার পর কলকাতার যে মঞ্চগুলিতে নাটকের শো হয়, সবগুলিতেই অভিনয় করেছি। কিন্তু প্রথম অ্যাকাডেমির মঞ্চে অভিনয় করার স্মৃতিটা এখনও ভীষণ জীবন্ত। কলকাতায় নাটকের শো থাকলে এখনও আমার আলাদা উত্তেজনা হয়। শহরের প্রত্যেকটি নাটকের মঞ্চের সঙ্গেই সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে যে!
শ্যুটিংয়ের কাজে যখন কলকাতার বাইরে যাই, তখন মাঝেমাঝে বাড়ির জন্য মন খারাপ হয়। আমার কাছে এই অনুভূতিটির মানে শুধু নিজের বাড়ি নয়, গোটা শহরটিও এই অস্থিরতার মধ্যে মিশে থাকে। কলকাতায় পা দিতেই সেই অস্থিরতা পালিয়ে যায়।
প্রকৃতি আর সবুজের কাছাকাছি থাকতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। আমি যখন ময়দানের পাশ দিয়ে গাড়ি করে ফিরি, যে কোনও রকম খারাপ লাগা বা মন খারাপ নিমেষে উধাও হয়ে যায়। এত সবুজ, খোলামেলা জায়গা, এই রকম দিগন্তবিস্তৃত মাঠ তো কলকাতায় খুব কমই আছে। গঙ্গার পাড় দিয়ে আসার সময়ও আমার এই রকম একটা অনুভূতি হয়। ওই গঙ্গার ঠান্ডা হিমেল হাওয়া ভিতর থেকে স্নিগ্ধ করে তোলে। তবে আমার যদি মনখারাপ থাকে, তা হলে গঙ্গার পাড়ে না গিয়ে ময়দানের পাশ দিয়ে হাঁটতেই বেশি পছন্দ করব। কারণ আমি দেখেছি যে, জলের কাছে গেলে আমার মনখারাপ আরও বেড়ে যায়। তাই এই শহরটিকে দেখতে দেখতে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ময়দানের ধার দিয়ে সোজা হেঁটে যাব। কতদিন আমার ভালবাসার শহরটিকে ছুঁয়ে দেখা হয়নি, জিজ্ঞেস করা হয়নি, ‘কেমন আছ কলকাতা?’