আমি যখন বাইরে যাই, তখন সেখানকার কাজ শেষ হলেই আমার মন কলকাতায় ফেরার জন্য ছটফট করতে থাকে। সেই অস্থিরতা নিয়ে প্লেনে চেপে বসি। প্লেনের চাকা কলকাতার মাটি ছুঁতেই জমাট বাঁধা অস্থিরতা, ছটফটানি, মনখারাপ, সব কেমন যেন এক নিমেষে উধাও হয়ে যায়। আমি মাঝেমাঝেই কান পাতলে এ শহরের হৃদ্স্পন্দন শুনতে পাই। অসম্ভব দ্রুতগতিতে তা বয়ে চলেছে।
আমার পরিবারে কেউ সিনেমা জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। আমি এবং নন্দিতাদি যখন ‘ইচ্ছে’ ছবিটি বানিয়েছিলাম, কলকাতার দর্শক কিন্তু তাঁদের ভালবাসা উজার করে দিয়েছিলেন। শুধু কি ‘ইচ্ছে’! এই শহরে ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’র মতো ছবিও সাহস নিয়ে তৈরি করতে পেরেছি। কলকাতা সেই ভরসা, শক্তি আর সাহস জুগিয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনও শহরে এই সিনেমা বানাতে গেলে আমাকে দু’বার ভাবতে হত। এই কলকাতায় আমি ‘গোত্র’-এর মতো একটি ছবি বানিয়েছি। সেটিও মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছেন। সমকালীন পরিস্থিতির প্রতিকূলে গিয়ে ‘হামি’ বানিয়েছি। ‘হামি’র প্রায় প্রত্যেকটি শো কিন্তু হাউসফুল ছিল। কাজেই কলকাতার মতো এত ভাল দর্শক আমার মনে হয় না, আর কোথাও পাওয়া যাবে। নিজস্ব ভাবনা, শিল্পচেতনাকে পরীক্ষা করে দেখার এক অসামান্য জায়গা হচ্ছে কলকাতা।
আমার একটি ঘটনা খুব বলতে ইচ্ছা করছে। ১৯৯৩ সালের কথা। বাবরি মসজিদ নিয়ে তখন বিস্তর তাণ্ডব হচ্ছে, শহর জুড়ে কার্ফিউ জারি হয়েছে। এমন একটি দিনে অ্যাকাডেমিতে সকালবেলা হাবিব তনভীরের একটি বিখ্যাত নাটক ‘চরণদাস চোর’-এর শো ছিল। আর আমি তখন বরাহনগরে থাকতাম। আমি বরাহনগর থেকে সাইকেল চালিয়ে নাটকটি দেখতে এসেছিলাম। সেখানে পৌঁছে অবাক হয়ে দেখেছিলাম যে, সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেও দর্শকাসন কানায় কানায় পূর্ণ। এ শুধু কলকাতাতেই সম্ভব।
আমার ছোটবেলাটা যেহেতু বরাহনগরে কেটেছে, ফলে কলকাতা ঠিক কেমন দেখতে, সেই সম্পর্কে ধারণা খুবই কম ছিল। আমার শৈশব কেটেছে গঙ্গার পাড়ে ঘুরে, গঙ্গার হাওয়া গায়ে মেখে। তার পর এক দিন দাদার হাত ধরে কলকাতার মেট্রো হলে প্রথম বাঘকে কেন্দ্র করে একটি সিনেমা ‘বর্ন ফ্রি’ দেখতে গিয়েছিলাম। আমার মনে আছে, সেই সিনেমা হলের নরম কার্পেটে পা দিয়েছি আর পা কার্পেটে ডুবে গিয়েছে। সে এক আলাদা অনুভূতি। তার উপর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হল। হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আমার কাছে তো তখন সবটাই নতুন। গোটাটাই একটা চমক ছিল। এই রকমও যে হতে পারে, আমার তখনও ধারণা ছিল না।
আমার আরও একটি ভাল লাগার স্মৃতি মনে পড়ছে। যখন আমরা প্রাক্তনের ‘কলকাতা’ গানটি শ্যুট করেছিলাম। আমাদের কলটাইম থাকত একদম সকালে। আমরা চিত্তদার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে, কলকাতার অলি-গলি, ক্যালকাটা ওয়াচ টাওয়ার, মনুমেন্ট হয়ে প্রায় গোটা শহরটি চষে ফেলেছিলাম। সব সময়ে তো কলকাতাকে এত কাছ থেকে দেখা হয় না। সেই সময়ের প্রত্যেকটি দিন আমার খুব ভাল কেটেছিল।
আমার জীবনের প্রেমের সঙ্গে কলকাতার প্রত্যেকটি মোড়, প্রতিটি রাস্তা জড়িয়ে আছে। কলেজ স্ট্রিট জড়িয়ে আছে, নন্দন জড়িয়ে আছে, সিনেমা পাড়া জড়িয়ে আছে। প্রেমের সঙ্গে মিশে আছে বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা, পার্ক স্ট্রিট মিশে আছে, মিশে আছে বাবুঘাট, শহরের অলি-গলি। এ এক বিশাল তালিকা। সহজে শেষ হওয়ার নয়। যখন কলেজে পড়তাম, তখন ধর্মতলা থেকে হেঁটে হেঁটে কলেজ স্ট্রিট যেতাম। এমনও হয়েছে যে উত্তর কলকাতা থেকে হাঁটা শুরু করেছি, গল্প করতে করতে কখন দক্ষিণ কলকাতায় চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি কখন এতটা হাঁটলাম। রবীন্দ্র সদনের পিছনে যে চাইনিজের দোকান আছে, সেখান থেকেও অনেক সময়ে খাওয়াদাওয়া করেছি। ফলে কলকাতা আমার কাছে প্রকৃত অর্থেই প্রেমের শহর। প্রেমে পড়ার শহর। ভাল লাগার শহর। ভালবাসার শহর।
এই কোভিড পরিস্থিতিতে যা সবচেয়ে বেশি মন টানছে, তা হল মধ্যরাতের কলকাতা। যখন কোভিড আসেনি, সেই সময়ে আমি রাতে গাড়ি নিয়ে বেরোতাম। দিনের বেলা যে অফিসপাড়ায় পা ফেলারও জায়গা থাকত না, রাতের নিস্তব্ধতায় অফিসপাড়ার ওই বড় বড় বাড়িগুলির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতাম। আর মায়াবী চাঁদের আলোয় আমার শহর ভেসে যেত। এখন আর কলকাতার সে রূপ দেখার সুযোগ মিলছে না।