লোকসভা ভোটে জয়ের পরে সাংবাদিক সম্মেলনে কালীঘাটের বাড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
রং বদল করল না বাংলা! এ বারও রাজ্য জুড়ে সবুজ!
দুর্নীতির অভিযোগে শাসক দলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী জেলে। আদালতের একের পর এক রায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়া নিয়েই বিস্তর চর্চা ছিল রাজনৈতিক শিবিরে। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের ‘কার্পেট বম্বিং’-এর বিরুদ্ধে ভোটে রক্ষণ সামলাতেই জোর দিতে হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসকে। সেই লড়াইয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে রাজ্যে ২৯টি আসন ঘরে তুলল শাসক দল। তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গী দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁরা তিন বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের মতোই লোকসভা ভোটেও বুথ-ফেরত সমীক্ষাকে খারিজ করে প্রায় ব’লে ব’লে মিলিয়ে দিলেন ভোটের ফল!
ভোট-চিত্রের নিরিখে দেখতে গেলে বাংলায় এ বার ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেরই পুনরাবৃত্তি। পাঁচ বছর আগের লোকসভা নির্বাচনের চেয়ে ভোট বাড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেস এ বার পেয়েছে ৪৫.৭৬%। বিধানসভা নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে যা সামান্য কম। বিজেপি পেয়েছে ৩৮.৭৩%, প্রায় তিন বছর আগের মতোই। বাম ও কংগ্রেসের সম্মিলিত প্রাপ্তি ১১.১৯%। বিধানসভা ভোটের চেয়ে ঈষৎ উন্নতি করলেও সার্বিক বিচারে বাম-কংগ্রেস জোট প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ। আবার আসনের নিরিখে বঙ্গে এ বারের ফল অনেকটা ২০১৪ সালের মতো। সে বারও কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপির সরকার কিন্তু রাজ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ৩৪টি আসন।
এমন একতরফা ফলের পরে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, তৃণমূলের এই সাফল্যের রহস্য কী! রাজনৈতিক শিবিরের ব্যাখ্যা, অনুদানের রাজনীতি ঢেকে দিয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারে’র মতো জনমুখী প্রকল্প মহিলাদের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের বড় অংশকে তৃণমূলের পাশে ধরে রেখেছে। তারই পাশাপাশি, দেশ জুড়ে বিজেপি-বিরোধী যে হাওয়া কাজ করেছে, যার জেরে কেন্দ্রে ভাল সংখ্যায় পৌঁছেছে বিরোধী জোট, তার ফায়দা রাজ্যে তৃণমূলও পেয়েছে। বাংলায় তাঁরাই বিজেপির প্রকৃত বিরোধী, রাজ্যের কংগ্রেস বা সিপিএম নয়— মমতার এই প্রচার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ হয়েছে বলে মেনে নিচ্ছেন বাম নেতৃত্বের বড় অংশও। মমতার বিজেপি-বিরোধিতায় ভরসা রেখে সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগই ফের তৃণমূলের বাক্সে এসেছে। উপরন্তু, বিজেপির তফসিলি ভোট-ব্যাঙ্কে ভাঙন ধরিয়ে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামের মতো এলাকায় জমি পুনরুদ্ধার করেছে মমতার দল।
বিপুল জয়ের পরে মমতা বলেছেন, ‘‘আমি খুশি মোদীজি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। উনি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। নৈতিকতার কারণে ওঁর দ্রুত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করা উচিত! নৈতিক দায় নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও (অমিত শাহ) পদত্যাগ করুন। কারণ, উনি বলেছিলেন, এ বার ৪০০ পার। আমি বলেছিলাম, দু’শো পার হয় কি না দেখুন। এ বার পগারপার!’’ তৃণমূল নেত্রীর আরও মন্তব্য, ‘‘এত অহঙ্কার ভাল নয়। মোদী বহু দলকে ভেঙেছেন। এখন জনতা ওঁকে, ওঁর মনোবল ভেঙে দিয়েছে। মোদী ক্ষমতায় না থাকলে, এর অর্ধেক আসনও তিনি পেতেন না।’’
বিজেপি এ রাজ্যে ফের ঘোষিত লক্ষ্য থেকে দূরে থেমে যাওয়ার পরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মনে করছেন, ‘‘সংখ্যালঘুরা ৯২% তৃণমূলকে সমর্থন করেছেন। যাঁরা নিজেদের জীবনযাত্রার উন্নয়নের কথা ভাবেননি। আর জনমুখী প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা যে ভাবে হুমকি দিচ্ছিলেন, তাতে কিছু জায়গায় মানুষ আতঙ্কিত হয়েছেন।’’ গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় বিজেপির এক শতাংশ ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও বিরোধী নেতার দাবি।
ঘর সামলে তৃণমূল নেত্রী আবার স্বভাবতই নজর দিচ্ছেন জাতীয় রাজনীতির দিকে। কেন্দ্রে এনডিএ এবং ‘ইন্ডিয়া’র প্রসঙ্গ এনে তাঁর মন্তব্য, ‘‘বিজেপিকে এখন পায়ে ধরতে হচ্ছে টিডিপি, নীতিশ কুমারের। ওদের ভাল চিনি আমি। মোদী-শাহ, বিজেপির এত অহঙ্কার, আমাদের রাজ্যের সব বিধায়ক, পুরপ্রতিনিধি-সহ সবাইকে ধমক দিয়েছে। কাউকে কাউকে টাকাও দিয়েছে। এর পরেও ‘ইন্ডিয়া জিতেছে। মোদী হেরেছেন। অযোধ্যাতেও হেরেছেন।’’ তাঁর দাবি, পোস্টাল ব্যালটে মোদীও হেরেছেন।
একা লড়ে সাফল্য পাওয়ার পরে কংগ্রেসকেএক হাত নিতেও ছাড়ছেন না মমতা। তাঁর কটাক্ষ, ‘‘আপনারা আমাকে অনেক সময় ‘আন্ডার এস্টিমেট’ করেন। আমি বলেছিলাম, তোমাদের দু’টো আসন (বাংলায়) দিচ্ছি। একটাও বিধায়ক নেই। দু’টো আসনেই জিতে যাবে। আমি বলেছিলাম, ‘ইন্ডিয়ার’ সবার সঙ্গে সমঝোতা করো, ১০০ আসন পাবে। কথাটা মিলল কি না?’’ এই সূত্রেই তাঁর অভিযোগ, ‘‘রাজ্যের কংগ্রেসের জন্য চার-পাঁচটা আসন হেরেছি আমরা। উত্তর দিনাজপুর, কলকাতা উত্তরে বিজেপি কংগ্রেসকে কত টাকা দিয়েছে? কংগ্রেস কোথা থেকে টাকা পেল? মনে হয় না দিল্লি থেকে টাকা পেয়েছে। বিজেপিই দিয়েছে!’’
লোকসভা ভোটের সাফল্যে ভর করে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাড়তি সুবিধা পাবে তৃণমূল। প্রস্তুতি শুরু করে দেবেন মমতা-অভিষেক। আপাতত রাজ্যে বিরোধী শিবির ছত্রভঙ্গ। এই সূত্র ধরেই প্রশ্ন উঠছে, রাজ্যে বিরোধী পরিসরে কি শূন্যতা তৈরি হবে? বিজেপি প্রত্যাশার অনেক দূরে থেমে গিয়েছে, প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ভূমিকা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বা বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পরাজিত হয়েছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, এই ফল এবং তার আশু প্রভাব রাজ্য রাজনীতির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কী বার্তা নিয়ে আসবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy