সরকারি চাকরির পরীক্ষা-প্রস্তুতির বইয়ের পসরা সাজানো গিল্লির মুখার্জি নগরের রাস্তায়। — নিজস্ব চিত্র।
‘কে চাকরির পরীক্ষায় বসবে? কোচিং ইনস্টিটিউট খুঁজছেন?’ ‘ইউপিএসসি, এসএসসি, পিএসসি, রেল, ব্যাঙ্ক, সিডিএস, এনডিএ, পুলিশ—কিসের পরীক্ষা বলুন?’ ‘কোর্স ফি কম করিয়ে দেব। ইনস্টলমেন্টে ফি দিতে চান?’
দিল্লির গুরু তেগবাহাদুর নগর মেট্রো স্টেশন থেকে বন্দা বাহাদুর মার্গ ধরে এগোলেই উড়ে আসতে থাকে প্রশ্ন, হাতে জমে ওঠে নানা সরকারি চাকরি-পরীক্ষার প্রশিক্ষণের বাহারি লিফলেট। ছেঁকে ধরেন কোচিং ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধিরা। রাস্তার দু’ধারে একের পর এক কোচিং সেন্টার। ভিতরের অলিতে, গলিতেও ঘরে ঘরে চাকরির পরীক্ষার প্রশিক্ষণ চলছে। সার দিয়ে ফটোকপির দোকান। চাকরির পরীক্ষার বই, খাতা, নোটস, আগের বছরের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের দোকান। বাড়িতে বাড়িতে পেয়িং গেস্ট, হস্টেলের বন্দোবস্ত।
দিল্লির মুখার্জি নগর। রাজধানীর ‘ইউপিএসসি হাব’। এক কথায় আইএএস, আইপিএস থেকে কেরানি পর্যন্ত যাবতীয় সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কাতারে কাতারে তরুণ-তরুণীর ভিড়। লক্ষ্য একটাই। সরকারি চাকরি। কেন্দ্রীয় সরকারের হোক বা রাজ্য সরকারের।
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বছরে দু’কোটি চাকরি। তাঁর সরকারের প্রথম আট বছরে মাত্র ৭.২২ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি হয়েছিল। লোকসভা ভোটের আগে শেষ দু’বছরে প্রধানমন্ত্রী রোজগার মেলা করে প্রায় আট লক্ষ সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র বিলি করেছেন। গত এপ্রিলে সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের সমস্যার কথা শুনতে এই মুখার্জি নগরে ঢুঁ মেরেছিলেন রাহুল গান্ধী। লোকসভা ভোটের বাজারে রাহুল অভিযোগ তুলেছেন, দেশের সব থেকে বড় সমস্যা বেকারত্ব। কংগ্রেস ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ ক্ষমতায় এলে ৩০ লক্ষ সরকারি পদে নিয়োগ হবে। লোকসভা নির্বাচনে সেই নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে। মুখার্জি নগরে পা দিলে উত্তর মেলে, সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। সেই প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতেই বিভিন্ন রাজ্যের ছেলেমেয়েরা দলে দলে মুখার্জি নগরে এসে ভিড় করছেন।
মুখার্জি নগরের এক নামী চাকরির পরীক্ষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কর্ণধার বললেন, ‘‘সরকারি রিপোর্টেই রয়েছে, ২০২১-২২-এ ইউপিএসসি বা ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন ১৬টি চাকরির পরীক্ষা নিয়েছে। ৩,৫৫৯ জন বিভিন্ন পদে চাকরি পেয়েছেন। এই সাড়ে তিন হাজারের মতো পদে চাকরির জন্য ২৯ লক্ষ ৯১ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছিল। অর্থাৎ, এক-একটি পদের জন্য ৮৪০ জন আবেদনকারী। প্রতিযোগিতা কতখানি কঠিন, বুঝতেই পারছেন।’’
বছর দুয়েক আগেই বিজেপি নেতৃত্ব টের পেয়েছিলেন, চাকরির অভাব নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। ২০২২-এ কেন্দ্রীয় সরকারই সংসদে জানায়, মোদী সরকারের আট বছরে মাত্র ৭.২২ লক্ষ সরকারি চাকরি হয়েছে। আবেদন জমা পড়েছিল ২২ কোটি। বিরোধীরা কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ লক্ষ শূন্য পদ নিয়ে সরব হন। সে বছর জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন, ২০২৩-এর ডিসেম্বরের মধ্যে ১০ লক্ষ সরকারি চাকরির পদ পূরণ হবে। ‘রোজগার মেলা’ আয়োজন করে চাকরির নিয়োগপত্র বিলি শুরু হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে শেষ রোজগার মেলা হয়েছে। ১২ দফা রোজগার মেলায় প্রায় ৮ লক্ষ নিয়োগপত্র বিলি হয়েছে।
‘‘ওই সব পদে তো এমনিতেই নিয়োগ হওয়ার ছিল। রোজগার মেলা করে সে সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারই বিলি করা হয়েছে’’—বিরক্তিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দেন হরিয়ানার ভূষণ গৌতম। বয়স বছর পঁচিশের কোঠায়। বাবা চাষের জমির কিছুটা অংশ বিক্রি করে ছেলেকে রেলের চাকরির প্রশিক্ষণের জন্য মুখার্জি নগরের কোচিংয়ে ভর্তি করে দিয়েছেন। ভূষণের ক্ষোভ, ‘‘রেলের চাকরি পাওয়া এখন কত কঠিন, বাড়ির লোক বুঝতেই চায় না। অন্য চাকরিতে প্রিলিমস, মেনস, ইন্টারভিউ, সব কিছুর জন্য আলাদা কোচিং!’’
বিহারের পটনা থেকে প্রশিক্ষণ নিতে মুখার্জি নগরে এসেছেন পবন যাদব। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কংগ্রেস ৩০ লক্ষ সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হবে বলছে। ক্ষমতায় এলে সত্যিই কি এই প্রতিশ্রুতি পালন হবে? বিশ্বাস হয় না।’’ তাঁর সঙ্গী সুনীল কুমারের হাতে ওবিসি সার্টিফিকেট রয়েছে। কিন্তু মনে সংশয়, ‘‘এখন তো সরকারি ক্ষেত্রেও ঠিকা নিয়োগ হচ্ছে। সেখানে সংরক্ষণের সুবিধা মিলছে না। সরকারি চাকরির বয়স পেরিয়ে গেলে কী করব, জানি না।’’
গত বছর এপ্রিলে মুখার্জি নগরে এসে রাহুল গান্ধী প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন দেশের ৯৯ শতাংশ তরুণ-তরুণী ১ শতাংশ চাকরির জন্য দৌড়বে? বিকল্প উপায় থাকবে না কেন? উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ থেকে বিএ পাশ করে মুখার্জি নগরে ব্যাঙ্কের পরীক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে আসা রুক্মিণী সিংহ বলছিলেন, ‘‘উপায় সত্যিই নেই। কম্পিউটারের কোর্স করতে গেলেও অনেক টাকা। তার পরে অতি কষ্টে মাত্র কুড়ি-বাইশ হাজার টাকা বেতনের বেসরকারি চাকরি মিলবে।’’
মুখার্জি নগরের রাস্তায় হোর্ডিং-ব্যানার-পোস্টারে চাকরির পরীক্ষায় সফলদের ছবি-সহ বিজ্ঞাপন। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারেইতিউতি নরেন্দ্র মোদীর ‘বিকশিত ভারত’ থেকে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের ‘জেল কা জবাব ভোট সে’-র বিজ্ঞাপন। ভূষণ, পবন, সুনীল, রুক্মিণীরা সে দিকে দেখেও দেখেন না। রুক্মিণী উত্তর দেন, ‘‘সরকারে যারাই আসুক, আমাদের পরীক্ষায় উতরেই চাকরি পেতে হবে। রাতারাতি প্রতিযোগিতা কমে যাবে না! ভোট নিয়ে তাই মাথা ঘামাই না।’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy