শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল ছবি।
বাংলায় এ বারের লোকসভা ভোটে বিজেপি শিবিরের প্রধান সেনাপতি ছ়িলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তৃণমূল কংগ্রেসের সেনাপতি হিসেবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিপুল সাফল্যের মুখ দেখলেন, তখন শুভেন্দুকে ভোটের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরতে হচ্ছে কার্যত খালি হাতেই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিশেষ ‘আস্থাভাজন’ শুভেন্দুই প্রার্থী বাছাই, সংগঠন থেকে শুরু করে প্রচার, সবেতেই মূল ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি রাজ্যে এগোতে তো পারেইনি, উল্টে আগের বারের থেকে ৬টি আসন কমে গিয়েছে। এর ফলে, বিজেপির অন্দরে শুভেন্দু চাপের মুখে পড়লেন বলেই মনে করছে রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ।
বিজেপি সূত্রের খবর, বাংলায় ফলাফল দেখে রাজ্যে তৃণমূল স্তরে সংগঠন আরও মজবুত করার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পাশাপাশি, আতস কাচের তলায় শুভেন্দুর নেতৃত্বও। এ বারের নির্বাচনে শুভেন্দুকে কার্যত ‘স্বাধীনতা’ দিয়েছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সেই কারণে দিলীপ ঘোষকে তাঁর কেন্দ্র থেকে সরিয়ে বর্ধমান-দুর্গাপুরে সরিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে আপত্তি জানায়নি দিল্লি। কিন্তু দলের খারাপ ফল এবং দিলীপের পরাজয় হওয়ায় শুভেন্দুর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশে। তা ছাড়া, টিকিট বণ্টনের ক্ষেত্রে শুভেন্দু যে ভাবে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে টিকিট দিয়েছেন, তা নিয়েও এই বিপর্যয়ের পরে প্রশ্ন উঠেছে।
যদিও বিজেপির একটি সূত্রের দাবি, এই ফলের জন্য শুধুমাত্র শুভেন্দু বা দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মতো ব্যক্তি বিশেষকে দায়ী করা ঠিক নয়। কারণ, তৃণমূল যে যে কারণে ভোট পেয়েছে, সেটা গোটা রাজ্যেই কাজ করেছে। সেই সঙ্গে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রের বিজেপির সরকারের বিরুদ্ধে কম-বেশি যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া ছিল, গোটা দেশের মতো রাজ্যের ফলেও তার প্রভাব পড়েছে। শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠ মহল জানাচ্ছে, বাংলায় প্রবল প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়াই তাঁরা আঁচ করেছিলেন। কিন্তু ফল যে এমন উল্টো হতে পারে, তার ধারণা ছিল না। তবে বিজেপিরই এক নেতা বলছেন, শুভেন্দু যে ধাতুতে গড়া, ফের নতুন করে কোমর বেঁধেই তিনি বিধানসভা ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে নামবেন।
শুভেন্দু নিজে যদিও এ দিন দলীয় কর্মীদের ‘রক্ষার’ বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “আমরা পাল্টা মারের বিপক্ষে। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের বলছি প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে। আইনি ভাবে আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়াব। কোনও ভাবেই তাঁরা যাতে নিজের হাতে আইন তুলে না নেন।” সেই সঙ্গে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী যে দিন শপথ নেবেন, সে দিন কারও অসুবিধা না করে ১২টি কেন্দ্রে যেখানে জয় এসেছে, সেখানকার নেতা-কর্মীদের বিজয় উৎসব পালনের জন্য বলেছেন তিনি।
বিজেপি এ বার বিদায়ী সাংসদদের অনেকেরই কেন্দ্র বদল করেছিল। যেমন, সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াকে বর্ধমান-দুর্গাপুর থেকে সরিয়ে আসানসোলে, মেদিনীপুর থেকে বর্ধমান-দুর্গাপুরে দিলীপ ঘোষকে, রায়গঞ্জ থেকে একেবারে কলকাতা দক্ষিণে দেবশ্রী চৌধুরীদের মতো দলের ‘তারকাদের’ প্রার্থী করা হয়েছিল। আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালকে প্রার্থী করা হয়েছিল মেদিনীপুর থেকে। কিন্তু তাঁদের কেউই নতুন কেন্দ্রে পদ্ম ফুল ফোটাতে পারেননি। বিজেপি সূত্রের খবর, এই কেন্দ্র-বদলে সায় ছিল শুভেন্দুরও। কিন্তু এই ‘কৌশল’ সফল না হওয়ায় এখন দলের অন্দরে শুভেন্দুকেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। তা ছাড়া, ‘তারকা প্রার্থীদের’ মধ্যে প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক, সুভাষ সরকার, লকেট চট্টোপাধ্যায়েরাও তাঁদের কেন্দ্র যথাক্রমে কোচবিহার, বাঁকুড়া, হুগলি থেকে হেরেছেন। হেরে গিয়েছেন, ভোটের আগেই দলবদল করে টিকিট পাওয়া ব্যারাকপুরের নেতা অর্জুন সিংহও। অর্থাৎ এক কথায় বিজেপির যাঁরা তারকা, তাঁদের বেশির ভাগই হারের মুখ দেখেছেন শুভেন্দু-সুকান্তের সেনাপতিত্বে। নিজের কেন্দ্র বালুরঘাট থেকে এই বারেও জিতেছেন সুকান্ত। তবে রাতে তাঁর কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের দাবিতে পুনর্গণনা শুরু হয়েছে। আর দিলীপের হার সম্পর্কে দলীয় সূত্রে ব্যাখ্যা, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, সাংগঠনিক শক্তি কম হওয়া সত্ত্বেও অল্প সময়ের মধ্যে দিলীপকে লড়তে পাঠানো হয়েছিল। তিনি চেষ্টা করেছিলেন।
এই হারের ‘দায়’ ব্যক্তি বিশেষের নয় বলেই দাবি করেছেন রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য। বাংলায় দলের ফল আশাপ্রদ নয় জানিয়েও তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের দুই আসন তমলুক ও কাঁথিতে দলের জয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই দুই আসনই রাজ্য রাজনীতিতে শুভেন্দুর খাসতালুক বলে পরিচিত। শমীক এ দিন বলেছেন, “পূর্ব মেদিনীপুর, যে জেলাকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাখির চোখ করেছিলেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে কাঁথি, তমলুক, দুই জায়গাতেই বিজেপি জিতেছে।” তবে প্রকাশ্যে বিজেপি নেতারা যা-ই বলুন, বিজেপির অধিকারীকে কেন্দ্র করে দলের অন্দরের রাজনীতি কোন দিকে যায়, সে দিকে নজর রাখছে রাজনৈতিক শিবির। আর দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ বলছেন, “বিপর্যয় হয়েছে। কেন এমন ফল, পর্যালোচনা করতে হবে।”
দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্য মনে করছেন, সাংগঠনিক ভাবে বাংলায় এখনও বেশ দুর্বল অবস্থায় রয়েছে বিজেপি। বিশেষ করে, তৃণমূল যে ভাবে একেবারে প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছে, তা বিজেপি এখনও করে উঠতে পারেনি। বুথ স্তর পর্যন্ত বিজেপির পর্যাপ্ত পরিকাঠামো এখনও ঠিক ভাবে গড়ে ওঠেনি বলেই মনে করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের এক নেতার বক্তব্য, বুথ স্তর পর্যন্ত দল মজবুত না হলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনেও আশাপ্রদ কিছু হওয়ার নেই। যদিও এ দিন দলের সদর দফতরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে রাজ্যের বিজেপি কর্মীদের চাঙ্গা করতে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডা বলেছেন, ‘‘বাংলায় একটি দল ২৯-৩০টি আসন পেয়ে উত্তেজনায় লাফাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি তিন থেকে সাতাত্তর আসন পেয়েছিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy