পূর্বস্থলীর বাবুইডাঙায় বন্ধ তাঁতে রাখা পেঁয়াজ। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল।
কোথাও তাঁতঘরে ঝুলছে তালা। কোথাও তাঁতযন্ত্রের কাঠে ঘুণ ধরেছে। কোথাও তাঁতঘরে রাখা হয়েছে মাঠ থেকে সদ্য তুলে আনা পেঁয়াজ। তাঁতশিল্পীদের মহল্লায় ঢুকলে অতীতের সেই কর্মব্যস্ততা আর দেখা যায় না। শোনা যায় না তাঁত টানার শব্দ। মহল্লার নৈঃশব্দ্যই বলে দেয় তাঁতশিল্পীদের হাল। লোকসভা ভোট এগিয়ে আসতেই যার কারণ নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে।
তাঁতশিল্পের জন্য পরিচিত কালনা মহকুমায় বহু তাঁতঘরেই এখন আর তাঁতি নেই। আগে ইদ, পয়লা বৈশাখের মরসুমে কাজের চাপে দম ফেলার সময় পেতেন না শিল্পীরা। আজ তাঁদের অনেকেই বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। কৃষির পরে এই জেলার সব থেকে বেশি মানুষ একদা নির্ভরশীল ছিলেন এই তাঁতশিল্পের উপরে। সব থেকে বেশি তাঁতশিল্পীর বাস এই কালনা মহকুমায়। ধাত্রীগ্রাম এবং সমুদ্রগড়ের টাঙ্গাইল শাড়ির সুনাম রয়েছে দেশের নানা প্রান্তে। তাঁতিদের দাবি, এক সময় মহকুমায় তাঁতশিল্পী ছিলেন ৫০ হাজারের বেশি। কাপড় বোনা ছাড়াও, রং করা, সুতো পাকানো, মাড় দেওয়ার মতো নানা কাজে ব্যস্ত থাকতেন সেই সব শিল্পীদের পরিবারের সদস্যেরাও। দুর্গাপুজো, ইদ, পয়লা বৈশাখে চাহিদা বাড়ত তাঁতের শাড়ির।
তাঁতিদের দাবি, দেড় দশক ধরে নানা কারণে শাড়ির চাহিদা কমছে। লকডাউন-এর পরে তাঁতের শাড়ির বাজার তলানিতে নেমেছিল। হাটে এবং মহাজনের কাছে শাড়ি বিক্রি করে কখনও স্বল্প টাকা লাভ হয়েছিল। কখনও হয়েছিল মোটা টাকার লোকসান। তার পরে একের পর এক হস্তচালিত তাঁতের ঘরে তালা পড়েছে। তাঁতশিল্পীদের কেউ এখন খেতমজুরি বা ট্রেনে হকারি করেন। কেউ বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভাঙাচোরা জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসার চালান। অনেকে আবার দিল্লি, মুম্বই,গুজরাতে পাড়ি দিয়েছেন কাজের খোঁজে। হস্তচালিত তাঁত ছেড়ে ঋণ নিয়ে বা জমানো টাকায় অনেকে ছোট পাওয়ারলুম যন্ত্র কিনে শাড়ি তৈরি শুরু করেছেন। গুজরাতের মতো কয়েকটি রাজ্য থেকে আসা সস্তার শাড়ি বাজার দখল করে নেওয়ায় মজুরি কমে গিয়েছে পাওয়ারলুমে। বহু পাওয়ারলুম বন্ধও হয়ে গিয়েছে।
পূর্বস্থলী ২ ব্লকের বাবুইডাঙা গ্রামের এক তাঁতশিল্পী এখন মুদিখানা দোকান চালান। তিনি বলেন, ‘‘এক সময় চারটি তাঁত ছিল। অভাব ছিল না ঘরে। এখনও একটিও চলে না। তাঁতঘরে পেঁয়াজ রেখেছি।’’ তাঁতশিল্পী আক্তার আনসারি শেখ জানিয়েছেন, এক সময় যে তাঁতের শাড়ি ১০০০-১১০০ টাকায় অনায়াসে বিক্রি করা যেত নবদ্বীপ, সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রাম, কলকাতার বিভিন্ন মহাজনের কাছে, লকডাউনের পরে তার দাম নেমে আসে ৫০০-৬০০ টাকায়। অথচ, সুতো-সহ নানা সামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে। বাধ্য হয়ে তাঁত বোনা ছেড়ে দিতে হয়। পূর্বস্থলী ২ ব্লকের তাঁতশিল্পী সাহাবুদ্দিন শেখ বলেন, ‘‘শীতকালে ফুল বিক্রি করি। তার পরে, হাতের কাছে যে কাজ পাই, তা-ই করি। এক সময় পাঁচটি তাঁত চলত। অর্থাভাব ছিল না। এখন সংসার কী ভাবে চলবে, সেই ভাবনা রোজ তাড়া করে।’’
লোকসভা নির্বাচনের প্রচার শুরু হতেই বিরোধীরা ‘শিল্প ধ্বংসের’ অভিযোগে বিঁধতে শুরু করেছে তৃণমূলকে। পূর্বস্থলী ১ ব্লকে বামেরা দেওয়াল লিখন ও পোস্টারে তাঁতশিল্পের বেহাল অবস্থার কথা তুলে ধরেছে। তাঁতশিল্পকে বাঁচাতে বর্ধমান পূর্ব কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী নীরব খাঁকে সমর্থনের আর্জি জানানো হয়েছে। সিআইটিইউ’র পূর্বস্থলী ১ ব্লক তাঁত শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা প্রবীর মজুমদার বলেন, ‘‘তাঁতশিল্পের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক। দেড় বছর আগে যে সুতোর বান্ডিল ১১০০ টাকায় কিনতে হত, এখন তার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২০০ টাকায়। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রং-সহ অন্য সামগ্রীর দাম। বাংলাদেশ ও গুজরাতে তৈরি নিম্নমানের শাড়ি চলে এসেছে বাজারে। তাতে তাঁতশিল্পীরা ব্যাপক চাপে পড়েছেন। তাঁতশিল্পীদের বলছি, বামপ্রার্থী সংসদে গেলে এই শিল্পকে বাঁচাতে লড়াই চালাবেন।’’ বিজেপির কাটোয়া সাংগঠনিক জেলার সভাপতি গোপাল চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, রাজ্য সরকারের নীতির কারণে তাঁতশিল্পীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ কথাই প্রচারে তুলে ধরছেন তাঁরা। পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা তৃণমূল দিলীপ মল্লিকের পাল্টা মন্তব্য, ‘‘বিরোধীরা ভোটের বাজার গরম করতে অনেক কিছু বলতেই পারেন। সুতোর দাম কেন্দ্রের সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। কেন্দ্রের নীতির জন্য তাঁতিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রাজ্য সরকার তাঁতের হাট ও হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার করেছে।স্কুলের পোশাক তৈরির বরাত দিয়েও তাঁতিদের পাশে দাঁড়িয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy