দমদমের সিপিএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর প্রচারে মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়দের রোড শো। ছবি: ফেসবুক।
‘ছোট’দের মুখ দিয়ে ‘বড়’দের কথা বলাতে চাইছে সিপিএম!
গত কয়েক বছর ধরেই বেশ কিছু নতুন মুখকে সামনের সারিতে তুলে আনার চেষ্টায় ধারাবাহিকতা দেখাচ্ছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। বাংলার লোকসভা ভোটে এ বার তা নতুন ঘরানার জন্ম দিল বলে মনে করছেন অনেকে। এই বদলের কথা মানছেন সিপিএমের নেতারাও। কেমন বদল? এত দিন দেখা যাচ্ছিল, ছোটদের ভোটে দাঁড় করালেও বড়রা যেতেন সেই প্রচারে। সেই বড় নেতাদের নামেই হত প্রচার কর্মসূচি। কিন্তু এ বার লোকসভা ভোটে উল্টো ছবি দেখা যাচ্ছে সিপিএমের প্রচারে।
মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। সেই আসনের বেশির ভাগ এলাকাই গ্রামাঞ্চল। সেখানে প্রচারের কৌশল এক রকম ছিল। দেখা গিয়েছিল— মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, ধ্রুবজ্যোতি সাহার মতো যুব নেতা-নেত্রীরা পড়ে থেকে কাজ করেছেন। তাঁদের নামে যেমন সভা-সমিতি হয়েছে, তেমনই তাঁরা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করেছেন। বুথস্তরের কর্মীরা যেমন করেন, তেমন ভাবেই। একই রকম ছবি দেখা গিয়েছে কৃষ্ণনগরের সিপিএম প্রার্থী এসএম সাদির প্রচারে। মিনাক্ষীর নামে একাধিক জনসভা করেছিল নদিয়া জেলা সিপিএম। সে সব সভার প্রচারে যুবনেত্রীর ছবি-সহ লেখা হয়েছিল ‘মিনাক্ষীর জনসভা’।
শুধু মিনাক্ষী নন। প্রবীণ নেতাদের প্রচারে আরও অনেক নবীন মুখকে সামনে রাখছে সিপিএম। তাঁদের মধ্যে ঐশী ঘোষ, দীপ্সিতা ধর, শতরূপ ঘোষেরা রয়েছেন। দমদমের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর সমর্থনে জনসভা তো বটেই, মিনাক্ষী-দীপ্সিতাদের নামে রোড-শোও করেছে সিপিএম। যা সিপিএমের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। ঘরোয়া আলোচনায় তা মানছেন দলের নেতারা। সুজন শুধু প্রাক্তন সাংসদ বা বিধায়ক নন, সিপিএমের সাংগঠনিক কাঠামোয় তিনি মিনাক্ষীদের থেকে অনেক উপরে। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সেলিম আবার দলের পলিটব্যুরোর সদস্য। দলের কাঠামোয় মিনাক্ষী কেবল রাজ্য কমিটির সদস্য। দীপ্সিতা, ঐশীরা তা-ও নন। দু’জনের দলীয় সদস্যপদ দিল্লিতে। সিপিএমের নেতাদের একটা সময়কার কমিটি-শ্লাঘা নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা চলত। কে কোন কমিটিতে রয়েছেন, তা দিয়ে বিবেচিত হত অনেক কিছু। কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে চাহিদা থাকলেও, নীচের কমিটির জনপ্রিয় নেতা-নেত্রীদের খানিক তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখতেন উপরের কমিটির নেতাদের কেউ কেউ। কিন্তু এ বার সেই কমিটির সূচকও কার্যত উবে গিয়েছে।
আলিমুদ্দিন সূত্রে খবর, এ বারের ভোটে বক্তা হিসেবে মিনাক্ষীর চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। সিপিএমের একাধিক জেলার নেতারা মানছেন, মিনাক্ষীর নামে বহু জায়গায় সমাবেশ আড়েবহরে এমন হয়েছে, যা স্থানীয় নেতাদের ধারণার মধ্যে ছিল না। তবে সেই তিনিও বুথে বুথে ছুটেছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন।
ঘরানা বদল প্রসঙ্গে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সেলিম বলেন, ‘‘এটা পরিকল্পিত ভাবেই করা হয়েছে। গত দু’বছর ধরেই আমরা প্রতিটি কর্মসূচিতে নবীন-প্রবীণের মিশ্রণ রাখছিলাম। এটা তারই ফলশ্রুতি।’’ কেন? তাঁর কথায়, ‘‘এটা বাস্তব যে, প্রতিটি প্রজন্ম তাঁদের দাবিদাওয়া, চাহিদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সেই কারণেই তরুণেরা গিয়ে তরুণদের কথা বলছেন। এটা বিজ্ঞান। কমিউনিস্ট পার্টি এই পথেই চলে।’’ কিন্তু এই অনুশীলনে কি মাঝে শ্লথতা এসেছিল? সেলিম বলেন, ‘‘মাঝে পার্টিকে বিবিধ আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেই কারণে কিছু শ্লথতা যদি থেকেও থাকে, আমরা তা পরিকল্পনা করে কাটাচ্ছি। এবং গতিশীল করে তুলছি।’’
তৃণমূলের মুখপাত্র শান্তনু সেন অবশ্য এই ঘরানা বদলকে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএম জানে, তাঁদের প্রবীণ নেতাদের সামনে রেখে প্রচার করলে মানুষের সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, ছোট আঙাড়িয়া, চমকাইতলা মনে পড়ে যাবে। তাই নবীনদের সামনে এনে নৈরাজ্যের ৩৪ বছরকে ভোলাতে চাইছে। তাতে লাভ হবে না।’’
শান্তুনুর পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন দমদমের সিপিএম প্রার্থী সুজন। তিনি বলেন, ‘‘মানুষই বুঝতে পারছেন বামেদের তরুণ প্রজন্ম তৈরি রয়েছে। বাকি দলগুলির নেই। অন্য দলের যাঁরা তরুণ নেতানেত্রী, তাঁদের সঙ্গে আমাদের ছেলেমেয়েদের ফারাকও স্পষ্ট।’’ মিনাক্ষী অবশ্য বলছেন, ‘‘আমরা কর্মী। আমাদের সব কাজ করতে হয়। আমরা তা-ই করছি। জনসভা থেকে বাড়ি-বাড়ি প্রচার, এ সবই আমাদের সারা বছরের কাজ।’’
সিপিএম তাদের তরুণ প্রজন্মের নেতা-নেত্রীদের প্রচারের সামনের সারিতে রাখলেও, স্থানীয় স্তরে তাঁদের অনেককে নিয়ে বিড়ম্বনাও পোহাতে হচ্ছে বলে খবর। সিপিএমের অনেক নেতাই ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, কেউ কেউ নিজেকে বড় ভেবে নিচ্ছেন। সভার আগে ফোন করে জানতে চাইছেন, জমায়েত কত হবে? অর্থাৎ, কম লোকের সামনে বললে বোধহয় তাঁদের মর্যাদা যাবে।
গত জানুয়ারি মাসে মিনাক্ষীদের নামেই ব্রিগেড সমাবেশ ডেকেছিল বামেরা। দেখা গিয়েছিল মঞ্চের নীচে বসে সভা শুনছেন বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রেরা। ‘বড়’দের মধ্যে কেবল মঞ্চে থেকে ভাষণ দিয়েছিলেন সেলিম এবং আভাস রায়চৌধুরী। বাকিটা সামলে নিয়েছিলেন ‘ছোট’রাই। সেই সভায় ভিড় হয়েছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সেই ভিড় ভোটবাক্সে কতটা প্রতিফলিত হবে, তা নিয়ে সভা শেষের পর থেকেই আলোচনা ছিল। হয়তো তা বুঝেই সেলিম ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে বলেছিলেন, ‘‘বুথে বুথে ব্রিগেড গড়তে হবে।’’ ব্রিগেডের ভিড়, প্রচারে তরুণদের সামনে এনে ঘরানা বদল কতটা কাজে লাগল, তা স্পষ্ট হয়ে যাবে পরের মঙ্গলবার, ৪ জুন। ওই দিনই দেশের ভোটগণনা। বাংলায় লাল পার্টির এই মুহূর্তের অবস্থাও স্পষ্ট হয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy