কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। —ফাইল চিত্র।
চিন পিছনে পড়ে গিয়েছে অনেক আগেই। খুব দ্রুত দেড়শো কোটির জনসংখ্যার গণ্ডিও ছুঁয়ে ফেলার পথে নরেন্দ্র মোদীর ভারত। এই আবহে আজ অন্তর্বর্তী বাজেটে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও জনবিন্যাসে পরিবর্তনের ফলে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা কী ভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তিনি বলেন, বিকশিত ভারত গড়ার লক্ষ্যে কমিটি ওই সমস্যাগুলি সমাধানে নিজেদের সুপারিশ সরকারকে জমা দেবে।
বিজেপি একে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বললেও, বিরোধীদের বক্তব্য, ভোটের মুখে মূলত মুসলিমদের কোণঠাসা করার বার্তা দিয়ে হিন্দু মেরুকরণের লক্ষ্যেই ওই পদক্ষেপ করেছে মোদী সরকার। তবে ওই কমিটি কবে রিপোর্ট জমা দেবে, তা অবশ্য স্পষ্ট করা হয়নি।
দেশে জনবিস্ফোরণ রুখতে দীর্ঘ সময় ধরেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি আনার পক্ষপাতী সঙ্ঘ পরিবার। এ নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে মোদী সরকারের উপর চাপ বাড়িয়ে চলেছে তারা। সঙ্ঘ মনে করে, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পিছনে মূলত দায়ী মুসলিমেরাই। হিন্দুদের তুলনায় পরিবারপিছু অধিক সন্তান জন্ম দেওয়াই জনবিস্ফোরণের অন্যতম কারণ বলে মনে করে গেরুয়া শিবির। সেই কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে সওয়াল করেন সঙ্ঘ নেতারা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে ২০১৯ সালে স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে বক্তৃতায় পরিবার ছোট রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, সকলের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা-স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত না হলে দেশ সুখী হতে পারে না। তিনি সে সময়ে নিজের বক্তব্যে কোনও সম্প্রদায়ের নাম নেননি ঠিকই, কিন্তু বলেছিলেন, সমাজের একটি অংশ পরিবারের জন্মসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। বিরোধীরা বলছেন, সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে সে সময়েই এই বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন মোদী।
এ কথা ঠিক যে, দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় হিন্দুদের তুলনায় মুসলিম জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি বেশি। কিন্তু পরিসংখ্যান এটাও বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি দশকে যে জনগণনা হয়েছে, তাতে দেখা গিয়েছে মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার তার আগের দশকের তুলনায় নিম্নমুখী (ব্যতিক্রম ১৯৮১-৯১)। ২০০১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে যে জনগণনা হয়, তাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির মোট হার ছিল ১৭.৭ শতাংশ। মুসলিমদের বৃদ্ধির হার ছিল ২৪.৬ শতাংশ। যেখানে তার আগের দশকে ওই হার ছিল ২৯.৫ শতাংশ। আর ২০০১-১১ এই কালপর্বে হিন্দুদের বৃদ্ধির হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ। জনগণনার দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল বা সেন্সাস কমিশনের কর্তাদের মতে, হিন্দুদের মতোই মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমশ কমে আসছে। ফলে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
সামনেই লোকসভা নির্বাচন। স্বভাবতই আজকের ঘোষণায় খুশি সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে বিজেপির এক বঙ্গ সাংসদ। তিনি বলেন, ‘‘পরিসংখ্যানগত তত্ত্ব বাদ দিন। হিন্দুরা জন্মহার কমাবে আর সরকারি প্রকল্পের সবচেয়ে বেশি ফায়দা পাবেন মুসলিমরা, কারণ পরিবার পিছু তাঁদের সদস্য সংখ্যা বেশি। এটা হতে পারে না।’’ পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে যে ভাবে জনবিন্যাস পাল্টে গিয়েছে, তা দেশের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের বলে মনে করে গেরুয়া শিবির।
অন্য দিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রুখতে সরকার আজ কমিটি গড়লেও, এর সঙ্গে আরও কিছু দিক তলিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রকের সমীক্ষা কিন্তু জানাচ্ছে, ভারতে জন্মের হার ক্রমশ কমায় দেশের জনসংখ্যায় বয়স্কদের হার বাড়ছে। একজন মহিলা গড়ে যত সন্তানের জন্ম দেন, তাকেই জন্মহার বলা হয়ে থাকে। ভারতের মতো দেশে জন্মহার যদি ২.১ থাকে, তা হলে জনসংখ্যা এক থাকার কথা। কিন্তু ২০২১ সালের পরে ওই জন্মহার দুইয়ের নীচে নেমে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণের রাজ্যগুলি জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন হওয়ায় সে সব রাজ্যে জন্মহার দাঁড়িয়েছে ১.৬-এর কাছাকাছি। যার ফলে স্বাধীনতার একশো বছরে দেশের এক-চতুর্থাংশ বাসিন্দার বয়স ষাটের বেশি হবে। কার্যত বয়স্কদের দেশে পরিণত হওয়ার দিকে এগোবে ভারত।
তা ছাড়া, কোন রাজ্য কেন্দ্রীয় করের কত টাকা পাবে, সেটা রাজ্যের জনসংখ্যার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি যদি জন্ম নিয়ন্ত্রণে ভাল কাজ করে থাকে, তা হলে নিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্রীয় করের অংশ কমে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন অর্থ কমিশন সদ্য গঠন হয়েছে। তাই কোন সমীকরণ মেনে আগামী দিনে রাজ্যগুলিকে অর্থসাহায্য করা উচিত, সেই ধাঁধার সমাধান এখন খুঁজতে হবে অর্থ কমিশনের কর্তাদের। কেননা রাজ্যগুলির বক্তব্য, জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে যদি অর্থসাহায্যই কমে যায়, তা হলে তা করে কী লাভ!
জনসংখ্যার সঙ্গে জড়িত রয়েছে লোকসভার আসন সংখ্যাও। কোন রাজ্যে ক’টি লোকসভা আসন থাকবে তা নির্ভর করে সেই রাজ্যের জনসংখ্যার উপরে। করোনার কারণে ২০২১ সালের জনগণনা এখনও হয়নি। তা হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। তার ভিত্তিতে লোকসভার আসন পুনর্বিন্যাস হওয়ারও কথা। ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণের রাজ্যগুলির আশঙ্কা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এক দিকে যেমন কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কমার আশঙ্কা রয়েছে তেমনই জনসংখ্যা কমে গেলে রাজ্যে লোকসভার আসনও কমে যাবে। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব হারাবে রাজ্য। উল্টো দিকে উত্তর তথা গোবলয়ের রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যা যদি তুলনামূলক ভাবে বাড়ে, সে ক্ষেত্রে লোকসভার আসন বাড়বে। এতে সার্বিক ভাবে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। এ ক্ষেত্রেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভাল কাজ করার ‘শাস্তি’ পাবে পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণের রাজ্যগুলি।
আজ বাজেটের পরে নির্মলা সীতারামন যে সাংবাদিক সম্মেলন করেন , তাতে প্রশ্ন ওঠে, দেশে জন্মহার যেখানে কমছে, সেখানে নতুন করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন আদৌ রয়েছে কি না। আর হলেও কী ভাবে তা হবে? চিনের মতো এক সন্তান নীতি নেওয়া হবে? আইন না মানলে কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে? যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর আজ এড়িয়ে গিয়েছেন নির্মলা। তবে আর্থিক বিষয়ক সচিব অজয় শেঠ জানান, ‘‘ভারতের যা জনসংখ্যা, তা এক দিকে সুবিধার, আবার সমস্যাও বটে। সব দিক খতিয়ে দেখে কমিটি রিপোর্ট দেবে। ওই কমিটির শর্তাবলি এখনও তৈরি হয়নি। হলে জানিয়ে দেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy